এক্সক্লুসিভ : মোহনবাগান ও বেলো রজ্জাকের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকব : সনি নর্ডি

সব্যসাচী বাগচী : তিনি পেশাদার ফুটবলার। বর্তমানে তিনি মেলাকা ইউনাইটেড দলের অন্যতম সদস্য। তবে যতই পেশাদারিত্বের জন্য অন্যত্র খেলুন, সনি নর্ডি'র হৃদয় জুড়ে এখনও শুধুই মোহনবাগান। এবং তাঁর মনের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছেন একজন নাইজেরীয় ডিফেন্ডার। তিনি বেলো রজ্জাক। কারণটাও খুব স্বাভাবিক। ২০১৫ সালের ৩১'মে সেবার বেঙ্গালুরু এফসি'র বিরুদ্ধে তাদের ঘরের মাঠে সনির বাঁক খাওয়ানো বিষাক্ত কর্নার থেকে বেলো গোল না করলে যে ইতিহাস লেখাই হত না। অধরা রয়ে যেত সঞ্জয় সেনের ছেলেদের লড়াই।
পাঁচ বছর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল। এই পাঁচ বছরের ব্যবধানে দুবার আই লিগ জিতল মোহনবাগান। তাই হয়তো 'হাইতিয়ান ম্যাজিশিয়ান'ও তাঁর আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। মালয়েশিয়া থেকে এক্সট্রাটাইম'কে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন সমর্থকদের হার্টথ্রব। মোহনবাগানে আসা থেকে সেবারের আই লিগ জয়, সমর্থকদের ভালবাসা থেকে খারাপ সময়। স্মৃতির ঝাঁপি উপরে দিয়ে সবকিছু নিয়ে অকপট সনি।
প্রশ্ন) আপনার হোয়াটসআ্যপ, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রামে নিশ্চয়ই একাধিক মেসেজ আসছে? পরিচিত মানুষ ও সমর্থকরা কি লিখলেন?
সনি) গতকাল রাত থেকেই একাধিক শুভেচ্ছাবার্তা আসছে। ২০০১-০২ মরসুমে শেষবার জাতীয় লিগ জেতার ১৩ বছর পর মোহনবাগান আবার 'ভারতসেরা' হল। ফলে এই আই লিগ জয়ের তাৎপর্য অনেক আলাদা। অনেক আবেগ জড়িয়ে আছে। তাই সমর্থকদের প্রতিটা মেসেজ সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখেছি। তবে আমি একটা কথা বলতে চাই। আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য মোহনবাগান কর্তাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। বাংলাদেশের ধানমুন্ডি অনেক বড় ক্লাব। সেই ক্লাবের হয়ে একাধিক ট্রফি জিতেছি। তবে মোহনবাগানের হয়ে খেলা সবসময় বাড়তি আনন্দ দিয়েছে। এবং সেটা শুধুমাত্র সমর্থকদের জন্য। তাই সবুজ-মেরুনের হয়ে আই লিগ ও ফেডারেশন কাপ জেতা আমার কাছে অন্য মাত্রা যোগ করেছে।
প্রশ্ন) বেঙ্গালুরু এফসি'র বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ সম্পর্কে কিছু বলুন।
সনি) সেবার লিগ টেবিল অনুসারে আমরা ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতাম। তবে সুনীলদের চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে জিততেই হত। তাই আমাদের কোচ সঞ্জয় সেন শুরু থেকেই জয়ের কথা ভেবেছিলেন। এবং আমরাও ইতিবাচক মানসিকতা নিয়েই মাঠে নেমেছিলাম। তবে ৪১ মিনিটে জন জনসনের গোলে ওরা এগিয়ে যেতেই দলের অনেকে চাপে পড়ে যায়। আজ তাদের নাম প্রকাশ করা উচিত হবে না। এরপর প্রথমার্ধের শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়ে আমরা নিজেদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। এবং সেখানে বড় ভূমিকা পালন করেছিল পিয়ের বোয়া। শিল্টন আমাদের অধিনায়ক হলেও, বোয়া ছিল দলের 'অদৃশ্য অধিনায়ক'। আর তারপর মাঠের ঘটনা তো সবাই জানে। ৮৬ মিনিটে আমার কর্নার থেকে হেডের সাহায্যে গোল করে বেলো। ও সেদিন গোল না করলে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যেত। তবে বেলোর দক্ষতার জন্য স্বপ্নভঙ্গ হয়নি। তাই ওর প্রতি চিরঋণী হয়ে থাকব।
প্রশ্ন) প্রথমবার মোহনবাগানে এসেই আই লিগ জিতলেন। পরের বছর ফেডারেশন কাপ। কিন্তু প্রথম ডার্বি খেলার মুহূর্ত কেমন ছিল?
সনি) দেখুন ডার্বি ম্যাচে সবাই পারফরম্যান্স করতে চায়। কিন্তু মোহনবাগানের মত বড় ক্লাবে ট্রফি জয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই টের পেয়েছিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে ক্লাব পর্যন্ত আসতে আমাদের অন্তত তিন-সাড়ে তিন ঘন্টা সময় লেগেছিল। সমর্থকদের উচ্ছাস-পাগলামি ছিল চোখে পড়ার মত। আর প্রথম ডার্বি ম্যাচের অভিজ্ঞতা মোটেও ভাল নয়। পিয়ের বোয়া গোল না করলে ম্যাচটা হেরে যেতাম। তবে সমর্থকরা কিন্তু আমাদের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। যা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন) ডার্বি প্রসঙ্গ আসলেই 'স্টেন গান' সেলিব্রেশনের প্রসঙ্গ আসে। কেন সেই বিশেষ সেলিব্রেশন করলেন?
সনি) আসলে সেই 'স্টেন গান' সেলিব্রেশনের পিছনে একটা গল্প আছে। সেই ম্যাচের আগে একাধিক ডার্বি খেললেও, শিলিগুড়ি ডার্বিতে প্রথম গোল করেছিলাম। এটা ছিল 'স্টেন গান' সেলিব্রেশনের একটা বড় কারণ। আর একটা কারণ হল সেই ম্যাচের কয়েকমাস আগে আমার ছেলে জন্ম নেয়। ও ঘরে হামাগুড়ি দিলে আমার স্ত্রী বলতো আমি যেন 'স্টেন গান' সেলিব্রেশনের মত ওকে তাড়া করি। আমি তাই গোল করে তেমনভাবে সেলিব্রেশন করি। এবং সেই ম্যাচের গোল পরিবারকে ডেডিকেট করেছিলাম। তবে সমর্থকরা যে আমার সেই সেলিব্রেশন এখনও মনে রেখেছে সেটার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
প্রশ্ন) আপনি কিন্তু চোটের জন্য একাধিক ডার্বি মিস করেছেন। সেটার জন্যও তো আপনাকে অনেক সমালোচনা হজম করতে হয়েছে।
সনি) আবার বলছি পৃথিবীতে এমন কোনও ফুটবলার নেই যে ডার্বি মিস করতে চায়। এই চোটের জন্য আমার কেরিয়ারের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষমতা থাকলে ২০১৭-১৮ ও ২০১৯-২০ মরসুমকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিতাম। আই লিগ জয়ের পরের বছর চোটের জন্য শিলিগুড়ি ডার্বি খেলতে পারলাম না। ২০১৭-১৮ মরসুমের মাঝপথ থেকে দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। পরের বছর প্রথম ডার্বি'র ক্ষেত্রে আবার চোট পেলাম। সেবার আই লিগের ফিরতি ডার্বি ম্যাচে ইউটা কিনওয়াকি শেষ মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নিল। যার মারাত্মক প্রভাব হল। একটা কথা মনে রাখবেন এই মূল্যবান ম্যাচগুলো না খেলার জন্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দল ও আমার হয়েছে। দল যেমন ভাল পারফরম্যান্স করতে পারেনি তেমনই যারা আমাকে ভালবাসেন, যারা আমাকে বিশ্বাস করতেন তারাও আমাকে ভুল বুঝেছেন। অহেতুক আমাকে বিতর্কে জড়ানো হয়েছিল। তবুও আমি ঠান্ডা মাথায় সব সামলেছি।
প্রশ্ন) আচ্ছা আপনি মোহনবাগানে ১৬ নম্বর জার্সি গায়ে চাপিয়ে খেলা শুরু করলেন। তারপর পড়লেন ১০ নম্বর জার্সি। এবং শেষ মরসুমে ৫০ নম্বর জার্সি পড়তে বাধ্য হলেন। বিশেষ কোনও কারণ?
সনি) আমার কাছে সবার আগে দল। ধানমন্ডিতে খেলার সময় ১০ নম্বর জার্সি পড়তাম। তবে সেই সময় কাৎসুমি ১০ নম্বর জার্সি গায়ে চাপাতো। তাই আমি ১৬ নম্বর বেছে নিয়েছিলাম। এরপর কাৎসুমি মোহনবাগান ছেড়ে যাওয়ার পর আমি ১০ নম্বর পড়তে শুরু করি। হাইতি দলেও ১০ নম্বর পড়তাম। এরপর হাঁটুর চোট পেয়ে দল চলে গিয়ে ফিরে আসার পর দেখলাম হেনরি কিসেকা ১০ নম্বর জার্সি গায়ে চাপিয়ে নিয়েছে। তাই ৫০ নম্বর জার্সি বেছে নিলাম।
প্রশ্ন) আই লিগে আপনার সেরা গোল?
সনি) যুবভারতি ক্রীড়াঙ্গনে মুম্বই সিটি এফসি'র বিরুদ্ধে ৩-১ ব্যবধানে দল জিতল। সেই ম্যাচে কাৎসুমির পাশ থেকে একটা একটা গোল করেছিলাম। সেটার পাশাপাশি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে শিলিগুড়ি ডার্বি'র গোল আমার কাছে সেরা।
প্রশ্ন) একাধিক কোচের অধীনে খেলেছেন। কিন্তু আপনার চোখে সেরা কোচ?
সনি) আমার কাছে সেরা কোচ হলেন সঞ্জয় সেন। আমার মতে উনি ভারতের অন্যতম সেরা কোচ। কারণ, উনি ফুটবলারদের কাছ থেকে সেরা বের করে আনার পাশাপাশি তাদের সম্মান করতে জানেন।
প্রশ্ন) আপনার চোখে সেরা ডিফেন্ডার?
সনি) জন জনসন।
প্রশ্ন) সেরা স্ট্রাইকার?
সনি) একজনের নাম বলা সম্ভব নয়। সুনীল, জেজের সঙ্গে বলবন্তের নামও রাখব।
প্রশ্ন) সেরা ডার্বি ম্যাচ?
সনি) ২০১৪-১৫ মরসুমে বলবন্তের গোল থেকে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে জয়। সেই ডার্বি জয়ের পর আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছিল।