কেন ডার্বি ম্যাচের শেষে ঘরে ঢুকতে পারেন নি প্রাঞ্জল? জানতে পড়ুন...

নিজস্ব প্রতিনিধি: সালটা ২০১৪। কলকাতা লিগের রবিবারের সেই ডার্বি ম্যাচে যুবভারতি স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরে উঠেছিল। বাঁশি হাতে ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রাঞ্জল ব্যানার্জি। সেই ম্যাচে র্যান্টি মার্টিন্সের গোলে এগিয়ে শুরুতেই এগিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। পরে মোহনবাগান গোল শোধ করলেও শেষরক্ষা হয়নি। ৩-১'এ জিতে সেবার মাঠ ছেড়েছিল লাল-হলুদ ব্রিগেড। যদিও ফিফা প্যানেলে থাকা বঙ্গ রেফারি প্রাঞ্জলের রাতটা কিন্তু মোটেও ভাল কাটেনি। কারণ, ওঁর বাবা সবুজ-মেরুনের অন্ধভক্ত। কী হয়েছিল ওঁর সঙ্গে? এক্সট্রাটাইম বাংলা ফুটবল শো-এর লাইভ অনুষ্ঠানে এসে সেটাই বলছিলেন প্রাঞ্জল।
প্রাঞ্জল বলছিলেন, "আমার বাবা মোহনবাগান সাপোর্টার। আমার জামাইবাবুও ওই একই ক্লাবের সমর্থক। তবে আমার জামাইবাবু সেই ক্লাবের সমর্থক হলেও, আমি মাঠে কোনও ভুল করলে বকা দিতেন না। বরং, মাঠেই খাতা-পেন নিয়ে যেতেন। সবকিছু খুঁটিনাটি লিখে রেখে আমাকে বোঝাতেন। তবে আমার বাবা একেবারে অন্যরকম মানুষ। সেই ম্যাচ খেলিয়ে ঘরে ফেরার পর কলিং বেল বাজাতেই বাবা বেরিয়ে এসে বললেন, তোর জন্য পুরো ম্যাচ দেখিনি! তুই আমাদের হারিয়ে দিলি! তাই একদম ঘরে ঢুকবি না। গোটা রাত বাইরে থাকবি।"
প্রাঞ্জলের জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে। ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে চোট। শুরুতেই স্বপ্নভঙ্গ। তবে প্রবাদপ্রতিম রেফারি প্রদীপ নাগের জন্যই রেফারিংয়ের ট্রেনিং নিতে শুরু করেন। সেটা ২০০৯ সাল। তবে নিষ্ঠা ও একাগ্রতাকে সম্বল করে ২০১৪ সালেই ফিফা এলিট প্যানেলে ঢুকে যান আগরপাড়ার এই যুবক। সেই সময় প্রাঞ্জল আবার মা'কে হারান। তবে ফোকাস হারাননি। প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেও ময়দান ঘুরে ম্যাচ খেলিয়ে গিয়েছেন। কাদা মাঠে ম্যাচ খেলাতে গিয়ে বুটের দফারফা হয়েছে। বাঁশি কেনার টাকা নেই। তবুও প্রাঞ্জলকে আটকানো যায়নি। শুধু প্যাশনের উপর ভর করে এগিয়ে গিয়েছেন।
মাঠে তাঁর প্রাঞ্জল উপস্থিতি ফুটবলের সৌন্দর্য বাড়ায়। ফুটবলাররা তাঁদের ফুটবল নৈপুণ্য সুন্দরভাবে মেলে ধরার সুযোগ পান। প্লে অ্যাক্টিংয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করা ফুটবলাররা তাঁকে সমঝে চলেন। কারণ, তিনি যে প্রাঞ্জল। যিনি এখনও প্রদীপ নাগের একটা কথা মেনে চলেন। প্রদীপবাবুর প্রসঙ্গ উঠতেই ওঁর প্রতিক্রিয়া, "স্যারের জন্যই আজ আমার পরিচিতি। উনি সবসময় আমাকে গাইড করেছেন। কোনও ম্যাচ খেলানোর পরেই ভিডিও ফুটেজ নিয়ে ওনার কাছে চলে যেতেন। উনিও সাধ্যমত বুঝিয়ে দিতেন। আর একটা কথা সবসময় বলতেন, 'সবাইকে সম্মান করবি। তবে কাউকে ভয় পাবি না।' আমি এখনও সেটাই মেনে চলি। তাই ডার্বি কিংবা অন্যকোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচ চাপমুক্ত হয়ে পরিচালনা করি।"
বর্তমানে ভারতীয় ফুটবলে রেফারিংয়ে শেষ কথা। তবে প্রাঞ্জলের মন ভাল নেই। আগরপাড়ার ছেলে প্রাঞ্জল চাকরি সূত্রে বর্তমানে শিলিগুড়িতে থাকেন। ময়দান থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণার সঙ্গে আপস করলেও প্রাঞ্জল তাঁর রেফারিং নিয়ে স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া। ভাল ফুটবলের জন্যে ভাল রেফারিং জরুরি। সঠিক ম্যাচ পরিচালনা ফুটবলের সৌন্দর্য বাড়ায়। ফুটবলার এবং দর্শকদের কাছ থেকে আদায় করে নেন সম্ভ্রম। তবুও রেফারিরা থেকে যান আড়ালেই। প্রতুল চক্রবর্তী, রবি চক্রবর্তী, মিলন দত্ত, নৃসিংহ চট্টোপাধ্যায়, সুদীন চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ নাগ, হাকিমদের মত রেফারিদের নাম তাই আড়ালেই থেকে গিয়েছেন।
বাংলার ফুটবলের ভাল মানের রেফারিদের ব্যাটন বয়ে চলেছেন প্রাঞ্জল। একটা চাকরির জন্য কলকাতা ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। সুঠাম চেহারা, দীর্ঘদেহী, উজ্জ্বল বর্ণের বছর ৩৪'এর এমবিএ পাশ করা এই তরুণ ভারতের সেরা রেফারি। ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে 'খেল সম্মান' স্বীকৃতিও দিয়েছেন। কিন্তু তারপর ওঁর প্রাপ্তি শুধুই আশ্বাস। অথচ কলকাতা শহরে থেকে ম্যাচ পরিচালনার কাজটি আরও সুষ্ঠুভাবে করতে পারতেন প্রাঞ্জল। রেফারিদের সরকারি চাকরির অতীত রেকর্ড রয়েছে। অথচ প্রাঞ্জল নবান্ন থেকে ক্রীড়াদপ্তরে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেও চাকরি পাননি। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী লক্ষীরতন শুক্লা ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নিয়ে প্রাঞ্জলকে কলকাতা ছাড়তে হয়েছে ।
বেশ আক্ষেপ নিয়ে প্রাঞ্জল বলছিলেন, "এক দিকে সংসারের চাপ অন্যদিকে ফিফা'র এলিট প্যানেলে পৌঁছানোর লক্ষ্য। দুয়ের মাঝখানে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেকারত্ব। আমার সামনে আর কোনও পথ খোলা ছিল না। বউকে নিয়ে কিছুটা উপায় না পেয়েই কলকাতা ছেড়েছিলাম। বছর দেড়েক হল শিলিগুড়িতে আছি। কলকাতা মাঠে নিয়মিত খেলানোর সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ তো রয়েছে। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ ও অফিস সাহায্য করেছে।" কলকাতা ছাড়ার কথা কখনও ভাবেননি। তাঁর বক্তব্য, "নিজেকে ম্যাচ ফিট রাখতে স্থানীয় লিগ, টুর্নামেন্ট খেলাই। এর পাশাপাশি আই লিগ, আইএসএলের ম্যাচ রয়েছে। ফিফা রেফারি হওয়ায় আমি বছরে ১৪-১৫'টা ম্যাচ পাই। এভাবেই একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি।"
শঙ্করের মতে তিনিও বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনার স্বপ্ন দেখেন। ইতিমধ্যে চারটি ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফায়ার খেলিয়েছেন। স্মরণীয় ম্যাচ বলতে ইরান বনাম কম্বোডিয়া ম্যাচ। ইরানে ওই ম্যাচ দেখতে মহিলাদের প্রথমবারের জন্যে স্টেডিয়ামে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিল। যা ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তবে আপাতত এশিয়ান কাপের ম্যাচ খেলানোকে পাখির চোখ করছেন প্রাঞ্জল।
কয়েক বছর আগে বাবা-মা গত হয়েছেন। স্ত্রী, সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে প্রাঞ্জলের সংসার। নিয়ম অনুসারে আরও এগারো বছর খেলাতে পারবেন। ৪৫ হয়ে গেলেই আর মাঠে নামতে পারবেন না রেফারিরা। প্রাঞ্জল বলছেন, "আমিও বিশ্বকাপে ম্যাচ খেলানোর স্বপ্ন দেখি। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপে সেটা হবে বলে মনে হয়না। তবে কাজটা কঠিন হলেও, অবাস্তব নয়। পরিশ্রম করলে ৪০ বছর বয়সে বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলাতেই পারি।"