এক 'বিরাট' শূন্যতা এবং টেস্ট ক্রিকেটের অপমৃত্যু......

সব্যসাচী বাগচী: ওঁ জঙ্গলে ঢোকার কিছু আগে থমকে দাঁড়ালেন! আমাদের মনে হয়েছিল ঘন জঙ্গলে ঢোকার আগে ওঁ নিশ্চয়ই একবার ফিরে তাকাবেন। নিজের কান দুটি খাড়া করে চিৎকার করবেন। এমন চিৎকার, যার আওয়াজে জঙ্গলের প্রতিটা গাছের পাতা, অন্যান্য জন্তু-জানোয়াররা সজাগ হয়ে যায়!
মনে হয়েছিল ওঁ আমাদের একবার শেষ বিদায় জানাবেন। এত বছরের সম্পর্কের একটা হ্যাপি এন্ডিং হবে। তেমনটা হল না। মনের ভিতরে একরাশ হতাশা, ক্ষোভ নিয়ে ওঁ জঙ্গলের আরও ভিতরে চলতে লাগলেন। এতটা ভিতরে, যেখানে সূর্যের আলো পর্যন্ত পৌছায় না!
তবুও মন বলছিল ওঁ একবার ফিরে তাকাবেন। কিন্তু কোথায়? অভিমান নিয়ে হাঁটতেই থাকলেন। কারও দিকে ফিরে তাকানোর ইচ্ছা ওঁর মধ্যে ছিল না। ওঁর মতো সিংহের কাছ থেকে এমন ব্যবহার তো আশা করিনি। আমাদের মতো অনেকেই বাচ্চার মতো কেঁদেছিলাম। মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিছু ভাল লাগছিল না।
আমরা কাঁদছিলাম কারণ জানতাম ওঁ আর ফিরে আসবে না। আমাদের হৃদয় ভেঙে খান-খান হয়ে গিয়েছিল। আমরাও বুঝতে পারছিলাম সবকিছু ছেড়েছুড়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট কখন হয় জানেন?যখন আপনি আপনার প্ৰিয় মানুষকে শেষ বিদায় জানাতে পারেন না। আপনার চোখের সামনে ভাল-মন্দ মুহুর্তগুলো ভেসে উঠবে। কিন্তু আপনার হাত-পা বাঁধা। কিছুই করতে পারবেন না।
টেস্ট থেকে বিরাট কোহলির অবসর। খারাপ তো লাগবেই। বুকে ঝড় উঠবে। কিন্তু কী আর করা যাবে। কালের নিয়মে সবাইকে সরে যেতে হয়। কোহলিও ব্যাট রেখে দিলেন! কিন্তু মোদ্দা কথা কোহলি যখনই অবসর ঘোষণা করতেন, চারিদিকে এমনই শূন্যতা তৈরি হত।
কিন্তু খারাপ লাগার আরও বড় কারণ কী জানেন? ভারতের এত বড় মাপের ম্যাচ উইনার। অধিনায়ক। বিশেষ করে টেস্টে দেশকে এত সাফল্য এনে দেওয়া লোকটা একটা ফেয়ারওয়েল ম্যাচ পেলেন না! যে লোকটা ভারতীয় দলকে এত ম্যাচ জেতানো পেস বোলার দিয়ে গেলেন, তাঁর কি আর একটু সম্মান প্রাপ্য ছিল না? তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক হিসেবে সরে দাঁড়ানো হোক কিংবা টেস্ট থেকে হঠাৎ অবসরের সিদ্ধান্ত, শেষের দিকটা বড্ড ম্যারম্যারে হল।
প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খানের একটা লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে। "I suppose, in the end, the whole of life becomes an act of letting go. What hurts the most is not getting a moment to say GoodBye!” বিরাটের কেরিয়ারের দিকে, আরও স্পষ্ট করে টেস্ট কেরিয়ারের দিকে তাকালে সেটাই তো মনে হচ্ছে।
শেষবারের মতো ওকে ব্যাগি ব্লু ক্যাপ মাথায় চাপিয়ে মাঠে দেখতে চেয়েছিলাম। সাদা ড্রেস পরে ওর মস্তানি দেখতে পারলে মন শান্ত হয়ে যেত। ওকে চিৎকার করতে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। বিপক্ষের ব্যাটারকে স্লেজিং করার মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে চেয়েছিলাম। বুমরাহ, শামি উইকেট পেলে কিংবা আউটের জন্য আবেদন করলে ওর লাফালাফি প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলাম। ফিল্ডিংয়ের মাঝে নাচতে থাকা বিরাটকে দেখতে চেয়েছিলাম। পিচকে চুমু খাওয়ার পর ওঁর দুই চোখের ক্লোজ-আপ শট দেখতে চেয়েছিলাম। ওঁকে একবার আউট হতে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। এমনটা হলে মনের ভার কিছুটা হালকা হত।
কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের মতো প্রায় সব হারানো ভারতীয়দের কাছে মন ভাঙা তো নতুন কিছু নয়। মন আগেও ভেঙেছে। এবার চুরমার হল। ভবিষ্যতেও কষ্ট পাব।
হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে আরও একজন ভারতীয় ব্যাটার আসবেন। রান করবেন। সবার মন জয় করবেন। আমরাও আনন্দে ভেসে যাব। কিন্তু বিরাটকে শেষবার টেস্ট খেলতে না দেখার দুঃখ কোনওদিন মিটবে না।
তবে বিরাট থামলেও, টেস্ট ক্রিকেট থামবে না। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে আগের গনগনে ব্যাপারটা থাকবে তো! কেন উইলিয়ামসন আছেন। রয়েছেন স্টিভ স্মিথ। জো রুট। ওঁরা তিন জন টেস্ট ক্রিকেটের পতাকাবাহক। কিন্তু রুক্ষ বাস্তব হল ফ্যাব ফোরের বাকি তিনজন কেউ বিরাটের মতো ক্রাউড পুলার নন। বিরাট শুধু টেস্ট ক্রিকেটের টর্চ বেয়ারার ছিলেন না। তিনি ছিলেন লাল বলের ফরম্যাটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।
তাই ১২৩টি টেস্টে ৯২৩০ রানে ওঁকে স্বেচ্ছায় নিজেকে আটকে রাখতে দেখে মনটা কেঁদে ওঠে। সিংহ হৃদয় 'কিং কোহলি' নিজের দুনিয়ার জঙ্গলে হারিয়ে গেলেন! একবার আলবিদা জানানোর সুযোগ দিলেন না। ফিরে তাকানো তো অনেক দূরের কথা।