ম্যাচ জেতানো ৮৭ রানের পরেও নির্লিপ্ত ঋদ্ধিমান। কিন্তু কেন? জানতে পড়ুন...

সব্যসাচী বাগচী : 'অসাধারণ। খুব স্মার্ট ব্যাটিং করল ঋদ্ধি। একটাও বাজে শট মারেনি। বরং দুর্বল বলকে জোরে আঘাত করেছে। তোমার ব্যাটিং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এনজয় করলাম।' ট্যুইট করলেন শচীন তেন্ডুলকর।
'ইয়েহি হ্যায় রাইট চয়েস বেবি, সাহা! দারুণ হিট করলে। তোমার ব্যাটিং এনজয় করলাম ঋদ্ধি'। এবার লিখলেন এক ও অদ্বিতীয় বীরেন্দ্র সেওহাগ।
'বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা উইকেটকিপারের অনবদ্য পারফরম্যান্স। রাতটা এনজয় করলাম।' এমনই টুইট করলেন জাতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী।
তবে এত প্রশংসার পরেও একেবারে নির্লিপ্ত ঋদ্ধিমান সাহা। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। ময়দান তথা বঙ্গ ক্রিকেট সমাজ পাপালি'কে সেভাবেই চেনে। ওর মধ্যে দেখোনদারি ব্যাপারটা মোটেও নেই। তবে মনের মধ্যে সুপ্ত অভিমান, ক্ষোভ এগুলো তো আছেই। ও যতই সেটা অস্বীকার করুক, শিলিগুড়ির ছেলেটার মধ্যেও এগুলো আছে। সেটারই প্রতিফলন ঘটল দিল্লি ক্যাপিটালসের বিরুদ্ধে। ৪৫ বলে ৮৭ রানের ওই ইনিংসটা যেন বারবার বলছে, 'আর কত ইগনোর করবেন?'
ঠিক একমাস আগের কথা। সবে আইপিএল আরম্ভ হয়েছে। কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে ৩১ বলে ৩০ রান করেছিলেন পাপালি। ব্যস বঙ্গসমাজ একেবারে রে রে করে উঠল। তারপর একমাস ডাগ আউটে বসে থাকা। সিনিয়র-জুনিয়র, দেশি-বিদেশি অনেকেই তো সুযোগ পেলেন। কিন্তু সাফল্য পেলেন কোথায়! সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদও ক্রমশ নিচের দিকে যেতে লাগল। কিন্তু ডু অর ডাই ম্যাচ আসতেই ডাক পড়ল তাঁর। যে কিনা শুধু ভারতীয় দল নয়, আইপিএল জগতেও বড্ড উপেক্ষিত। আর এবার তো শুধু ডাক পড়ল না, একেবারে জনি বেয়ারস্টো বদলি হিসেবে দলে এলেন। ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে ওপেনিং'ও করলেন। বাকিটা মনে হয় আর লেখার দরকার নেই। সবার মনে ওর বিস্ফোরক ব্যাটিং একেবারে গেঁথে গিয়েছে।
বছর ৩৪ হলেও ফিটনেস মারাত্মক। বঞ্চিত ঋদ্ধি আর কত বছর খেলবেন! বড়জোর আরও চার কিংবা পাঁচ। আসলে কিছু কিছু খেলোয়াড় থাকেন যাদের গোটা কেরিয়ার প্রমাণ দিতেই কেটে যায়। ঋদ্ধি সেটা জানেন। এবং বুঝে গিয়েছেন। তিনি যতই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দুরন্ত ব্যাটসম্যান হোন, তাঁকে যে বিরাট কোহলি সাদা বলের খেলায় সুযোগ দেবেন না, সেটা পাপালি বেশ বুঝে গিয়েছেন। দুনিয়ার সেরা উইকেটকিপার হয়েও নিউজিল্যান্ডে গিয়ে টেস্ট সিরিজে বসে থাকতে হয়। সুযোগ দেওয়া হয় ঋশভ পন্থকে।
যদিও দিল্লির বিরুদ্ধে ম্যাচের সেরা হয়ে বলছিলেন, "চলতি আইপিএলে এটা আমার দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল। তবুও জড়তা ছিল না। ওয়ার্নার মন খুলে ব্যাট করার পরামর্শ দিয়েছিল। সেভাবেই দুর্বল বলকে বাইরে পাঠিয়ে ইনিংস গড়েছি। তবে কাজ এখনও অনেক বাকি। শেষ দুটো ম্যাচ মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ও রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে। প্লে-অফে যেতে হলে ওই দুটো ম্যাচ জিততেই হবে।"
অসাধারণ 'টিম ম্যান'। মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। বিরাট কোহলি থেকে লক্ষী রতন শুক্লা। রোহিত শর্মা থেকে মনোজ তিওয়ারি। কেরিয়ারে একাধিক অধিনায়কের অধীনে খেলেছেন। পাপালি সম্পর্কে সবার ব্যাখ্যা এক। 'ঋদ্ধির ওয়ার্ক এথিক্স দারুণ'। এটাই সবার থেকে ওকে আলাদা করে। ওর কাছে আন্তর্জাতিক কিংবা আইপিএল ম্যাচের গুরুত্ব যেমন, ঠিক তেমনই গুরুত্ব দিয়ে ক্লাব ম্যাচ খেলেন ঋদ্ধি। অস্ত্রোপচার হওয়ার পরেও চোটের পরোয়া না করে ডান কাঁধের উপর ভর করে ডাইভ দেন। সেটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ হোক কিংবা হাই কোর্ট মাঠে মোহনবাগান বনাম কাস্টমস ম্যাচ। 'সুপারম্যান'এর কাছে সব ম্যাচ সমান। এটাই ওর স্টাইল স্টেটমেন্ট।
ক্রিকেট ঘোর অনিশ্চয়তার খেলা। আর ফ্রাঞ্চাইজি বেষ্টিত আইপিএল তো আরও অনিশ্চয়তার। আরও বেশি জটিল। পরের ম্যাচগুলোতে ঋদ্ধি ফের রান করবেন কিনা সেটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। তবে মাঠে থাকলে ও ১০০% দেবেন, সেটা গ্যারান্টি দিয়ে লেখা যায়। কারণটা হয়তো ঋদ্ধিও বুঝে গিয়েছেন। তিনি যতই পারফর্মার হোন, তিনি তো আর ঋশভ পন্থ নন। তাঁর কোনও গড ফাদার নেই। বাইশগজের যুদ্ধে ওর বেঁচে থাকার ভরসা সেই ব্যাট ও গ্লাভস। এগুলো নিয়েই প্রতি মুহূর্তে একাধিক শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন 'সুপারম্যান'। অবশ্য তাঁর কেরিয়ার মাঝপথে বারবার থমকে যাওয়ার পেছনে চোট-আঘাত বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে।
অবশ্য প্রতিপক্ষ শুধু বাইশগজের যুদ্ধে কিংবা ড্রেসিংরুমের আনাচে কানাচে নেই। সমাজেও আছে। সেই প্রতিপক্ষের নাম বাঙালি। যারা গোটা দুনিয়াতে কাঁকড়ার জাত নামে কুখ্যাত! তাই হয়তো আপনার সঠিক মূল্যায়ন করা গেল না। পারলে বঙ্গ সমাজকে ক্ষমা করবেন 'বঙ্গ ক্রিকেটের নতুন আইকন'।