ক্রীড়াসাংবাদিক পার্থ রুদ্রের পাশে দাঁড়ান : অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়

অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় : পার্থদাকে দেখে রুস্তম আক্রামভ বলেছিলেন, তুমি ফুটবল খেলো না কেন!! Here reporters big big, footballers short short'….. একেবারে রুস্তমীয় ইংরেজিতে উজবেক কোচের বিস্ময় প্রকাশটা ছিল ঠিক এইরকম। হবে নাই বা কেন, এক ভারতীয় সাংবাদিক ছয় ফুটের বেশি হাইট নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে ঢুকছেন, ঋজু চেহারা, জাভেরিয়ান চোস্ত ইংরেজি বলছেন। ওকে দেখে সবার থেকে আলাদা করে নিতে তো সময় লাগত না। আর আমরা যারা ওকে কাছ থেকে চিনি, জানি- তারা জানি খেলাধুলা নিয়ে ওর প্যাশনটা ঠিক কী রকম।
সব খেলা বুঝত, সব খেলার খোঁজ রাখত, আর খেলা নিয়ে তর্কটা? সেটা নব্বই দশকের কোন দুপুরে কিংবা বেশি রাতে আজকাল পত্রিকার খেলার দপ্তরে কান পাতারও বোধহয় দরকার ছিল না। আমার ধারণা, আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকেই শোনা যেত। আর নিঃসন্দেহে পার্থ রুদ্রর গলাটাই বেশি। জানিনা, উচ্চতার সঙ্গে গলার আওয়াজের কোন সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে কিনা! ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস কোন বিষয় নিয়ে সেসময় আমাদের তর্ক নেই! এই তর্কগুলোই আসলে সমৃদ্ধ করেছে আমাদের সবাইকে।
আজ যা করে বেড়াই, সবটাই ওই আজকালের স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট। আমাদের মনের ম্যাগাজিন ছিল, খেলা। খেলায় লেখাটা ছিল একটা প্যাশন। কত রাত ওই ডিপার্টমেন্টে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছি আমি আর পার্থদা। ওর বাড়ি সেই ঠাকুরপুকুর। আমার বাড়ি দক্ষিনেশ্বর। খেলার লেখার ডেডলাইন এগিয়ে এলে অফিসে থেকে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকত না। নাইট ডিউটি শেষ করে ৯৬ রাজা রামমোহন সরণীই আশ্রয়। লেখা শেষ হলে, চেয়ার জড়ো করে অথবা লম্বা ডেস্কের ওপর শুয়ে পড়তাম আমরা। ডেস্কের বাইরে পা ঝুলত পার্থদার, তাই চেয়ারে ঘুমোত, আর আমি ডেস্কে। দুজনের মাথাতেই কাগজের ফাইল। নিউজপ্রিন্টের গন্ধ মেশানো সেই কাগজ বালিশই আমাদের সব ক্লান্তিকে অনায়াসে ক্ষমা করে দিত।
আজকালে তখন জমজমাট ইন্টার ডিপার্টমেন্ট খেলা হত। খেলা তো নয়, রীতিমতো যুদ্ধ। স্পোর্টস এডিটর ধীমানদা উত্তেজিত, প্র্যাক্টিস হচ্ছে, স্ট্যাটেজি হচ্ছে, প্রাইজ দিতে আসছেন সম্বরণ ব্যানার্জি কিংবা গোপাল বসুরা। আদপে টেনিস বল ক্রিকেট, কিন্তু তা নিয়েই রীতিমতো টেস্ট ম্যাচের মত হইচইয়ে ব্যাপার। আমাদের এডিটোরিয়াল বিভাগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজ্ঞাপন। প্রতিবারই নাকি হারে এডিটোরিয়াল। একবার জিতলাম আমরা। ফাইনালে হারল সেই বিজ্ঞাপন। মাথায় হেড ব্যান্ড পরে ঝাঁকড়া চুলের পার্থদার বল হাতে কামাল। আমার লাস্ট বলে ছয়। মনে হয়, এই তো সেদিন।
কিন্তু আমাদের সেদিন যে আস্তে আস্তে পশ্চিমের দিকে ঢলেছে, সেদিন পার্থদাকে দেখে বুঝতে পারলাম। টাটা ক্যান্সার হাসপাতালের বেডে পার্থদার দিকে ভাল করে তাকাতে পারছিলাম না। এই তো সেদিনও সব ঠিক ছিল। আজ কেন এইরকম। বিছানায় মিশে যাওয়া এক ছয় ফুট, ঘুমোচ্ছে। দেখে অস্ফুটে একবার বলল, বোস। সারা শরীরে নানা পরীক্ষার নিশান। গত কয়েকমাসে এই শরীরটা নিয়ে যে অনেক কাঁটাছেড়া চলেছে।
নিজের কথা অনেক বলে ফেললাম। এবার কাজের কথায় আসি। পার্থদার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে। অনেক। ওকে অবিলম্বে মুম্বই নিয়ে যেতে হবে। ওর চিকিৎসার জন্য অনেকটা দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন সৌরভ গাঙ্গুলি। প্রতিটা মূহুর্তে পার্থদার পরিবারকে ভরসা যুগিয়ে যাচ্ছেন, আমি আছি। কিন্তু সৌরভই বা একা কত করবেন। এই খরচের তো কোন তল নেই। শুধুই গভীরে টেনে নিয়ে যাওয়া।
পার্থদার পরিবার তাই ঠিক করেছে, যদি কিছু টাকা তুলতে পারে। পার্থ রুদ্রকে তো ভালবাসতেন আরও কিছু মানুষ, তারাও যদি এই লড়াইটায় পাশে থাকে।
লড়াই? হ্যাঁ লড়াই। গত বছর কঠিন একটা অপারেশন করে দেহের ম্যালিগন্যান্ট সেলগুলোকে বার করে এসেছিল পার্থদা। অফিসে জয়েনও করেছিল।দেখাও হল একদিন। তখনও কত প্রত্যয়। "আমাকে বাঁচতেই হবে রে"…..
আর সেটা নিয়েই লড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। লড়াইটা ছেড়ো না পার্থদা। গেলারো বুং কর্ণ স্টেডিয়ামটা মনে আছে তোমার? সেই ফাইনালটা! ৯০ মিনিটের আগে কে ভেবেছিল, বেক তেরো সাসানা হারবে! জাকার্তা থেকে পাঠানো তোমার ম্যাচ রিপোর্টটা মনে আছে? কিংবা ২০০৪ এ পাকিস্তান থেকে জিতে আনা সৌরভ গাঙ্গুলির সেই সিরিজটা! ওগুলোও তো সব হারা ম্যাচ ছিল পার্থদা। মাঠে বসে সব দেখা তোমার। হারার আগে ম্যাচ ছেড়ে দেবে? হতেই পারে না!
এই মাঠটায় তুমি একা লড়ছো না। দেখো মিতালি লড়ছে, বুড়ি লড়ছে, চৈতিদি লড়ছে, অমর্ত্য লড়ছে। আমার বিশ্বাস, তোমাকে ভালবাসার সব মানুষগুলো এই লড়াইয়ে পাশে থাকবেন।
আবেদনটা তাই খেলার মাঠের সবার কাছে। ভাল নেই পার্থদা। ভাল নেই ওর পরিবারও। যদি সত্যিই পারেন, তাহলে ওদের পাশে থাকবেন। নিচে একটা লিঙ্ক দেওয়া আছে, সেটাতে ক্লিক করলে পার্থদার চিকিৎসার জন্য পাশে থাকা যাবে। মাঠের মানুষের জন্য মেঠো মানুষদেরই যে থাকতে হবে।
হাল ছাড়ছি না আমরা, পার্থদা।