লিভারপুলের আধিপত্যের কারিগর ক্লপ ও তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র গেগেনপ্রেসিং - কলম ধরলেন সুভাষ ভৌমিক

জুরগেন ক্লপ যে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা কোচ, সন্দেহ নেই। কিন্তু, অনেকেই তাঁর লিভারপুলের দিনগুলোই শুধু মনে রেখেছেন, যদিও এই জার্মান ম্যানেজার কাজ শুরু করেছিলেন অনেক আগে। বুন্দেশলিগায় মাইনজ এবং বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে দুর্দান্ত কাজ করেই এসেছিলেন প্রিমিয়ার লিগে। এই লেখায় তুলে ধরা হচ্ছে ওঁর বিখ্যাত ‘গেগেনপ্রেসিং’-এর স্বরূপ।
গেগেনপ্রেসিং-এর গুরুত্ব: ট্যাকটিক্যাল দিক দিয়ে দেখতে গেলে ক্লপের ডর্টমুন্ড মূলত নির্ভর করত ট্রানজিশন অর্থাৎ খেলার একটি পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে যাওয়ার সময়ের মুহূর্তগুলোতে। ডিফেন্সিভ ট্রানজিশন নিখুঁত রেখে ক্লপ বিশেষ জোর দিয়েছিলেন দ্রুত বিপক্ষকে প্রেস করার ওপর। বলের দখল হারালেই ফিরে পাওয়ার জন্য প্রেসিং, যত দ্রুত সম্ভব। তখনই নাম দেওয়া হয়েছিল
‘গেগেনপ্রেসিং’ বা ‘কাউন্টার প্রেসিং’, মূল ভাবনা ছিল, বলের দখল পায়ে পাওয়ার ঠিক পরের মুহূর্তেই বিপক্ষ সবচেয়ে ভঙ্গুর থাকে কারণ, রক্ষণ থেকে আক্রমণে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করতে হয়। ‘গেগেনপ্রেসিং’-এর লক্ষ্যই ছিল বিপক্ষের ওই মুহূর্তের অসতর্কতার ফায়দা তুলে বলের দখল নিজেদের পায়ে ফিরিয়ে আনা।
এই ‘কাউন্টার প্রেসিং’ কার্যকরী করতে গিয়ে ডর্টমুন্ড আক্রমণে যেত সরু-পথে। মোটামুটি, মাঠের একটাই দিক কাজে লাগাত। লক্ষ্য থাকত, ওই দিক দিয়েই আক্রমণে গিয়ে বিপক্ষের অস্বস্তি বাড়ানো। একই সঙ্গে লক্ষ্য থাকত, হঠাৎ বলের দখল হারালে নিজেদের শেপটাও যাতে বিক্ষিপ্ত না হয়ে যায়। প্রান্তরেখা বরাবর খেলতে থাকলে বিপক্ষের পাসিংয়েও সীমাবদ্ধতা এনে দেওয়া সম্ভব, যা ‘গেগেনপ্রেসিং’-এর অন্যতম সুবিধা। বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে জার্মান কাপ ফাইনালে যে ম্যাচটা ৫-২ জিতেছিল ক্লপের ডর্টমুন্ড, বায়ার্ন ফুটবলারদের পরের পাস ধরে নেওয়ার জন্য একেবারে নির্দিষ্ট জায়গায় থাকছিলেন ডর্টমুন্ড ফুটবলাররা। আসলে, ‘গেগেনপ্রেসিং’-এর মূল কথাই হল, বলের দখল ফেরত পেলেই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে প্রতিআক্রমণে গোল তুলে নেওয়া। যে-কারণে ক্লপ বলেছিলেন ‘খেলা তৈরির সেরা অস্ত্রই হল গেগেনপ্রেসিং’।
লিভারপুলের খেলার ধরন যদি লক্ষ্য করেন, পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, ডর্টমুন্ডের এই খেলার ধরনটাই অ্যানফিল্ডে আমদানি করেছিলেন ক্লপ। হ্যাঁ, লিভারপুলের আক্রমণের কৌশল একটু হলেও আলাদা, যে জন্য প্রভাবিত হয় ওদের রক্ষণের স্ট্র্যাটেজিও। ইংল্যান্ডে যেহেতু বিপক্ষ গোলশূন্য ড্র হলেই সন্তুষ্ট থাকে, বলের দখল থাকা সত্ত্বেও লিভারপুল অপেক্ষা করতে বাধ্য হয় বাড়তি কিছুটা সময়। তা ছাড়াও, বিপক্ষ বলের দখল পাওয়ার পরও সাবধানী থেকেই আক্রমণে এগোয়। ‘গেগেনপ্রেসিং’ তাই তখনও গুরুত্বপূর্ণই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রতি আক্রমণে যাওয়াটা হয়ে ওঠে না, যতটা হত জার্মানিতে। ফলে, প্রতি আক্রমণে দ্রুত যাওয়ার তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল বল-পজেশন ধরে রাখাতেই। পায়ে বল পেয়ে প্রথমেই ফরোয়ার্ড পাস না খেলে সমান্তরাল বা ব্যাক পাস খেলে বল ধরে রাখায় জোর দিয়েছিল লিভারপুল। কারণ, ইংল্যান্ডে এত দ্রুত বিপক্ষকে ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগও তুলনায় কম।
প্রেসিং-এর ট্রিগারে চাপ দেওয়ার বিবর্তন: অ্যানফিল্ডে পাঁচ বছরে ক্লপ শুধুই আক্রমণে যাওয়ার কৌশলে এই পরিবর্তন এনেই নিজের কাজ শেষ করেননি। বরঞ্চ, নতুন করেই সাজিয়েছিলেন ‘গেগেনপ্রেসিং’। ডর্টমুন্ডের খেলার পুরনো ভিডিও যদি দেখেন, বিশেষ করে বায়ার্নের বিরুদ্ধে খেলাগুলো, মাঝমাঠে বিপক্ষকে আটকানোর চেষ্টায় ক্লপ তখন ৪-৪-১-১ ছকে চলে যেতেন। সামনের দুজন ফুটবলারের ছায়া তখন বিপক্ষকে মাঝমাঠে বেশি পাস খেলতে দিত না। বিপক্ষের পেনিট্রেটিভ পাসের সম্ভাবনা কমিয়ে নিজেরাই চেষ্টা করত সেই মুহূর্তেই আক্রমণে এগোতে। কখনও বিপক্ষের ভুল-পাস, বল ধরার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা বিপক্ষের ফুটবলারের গায়ে-লেগে-থাকা ডর্টমুন্ড ফুটবলারের উপস্থিতির অর্থই তখন ডর্টমুন্ড শুরু করে দিয়েছে তাদের ‘গেগেনপ্রেসিং’, ক্রমশ আটকে দিচ্ছে বিপক্ষের পাস দেওয়ার সম্ভাব্য জায়গাগুলো। এখানে যদিও মনে রাখা ভাল যে, বিপক্ষ যদি ব্যাক পাস খেলে বলের দখল ধরে রাখতে আগ্রহী হয়, ডর্টমুন্ড কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিং-এ যেত না সাধারণত। আর এখানেই লিভারপুল আলাদা। লিভারপুল কিন্তু বিপক্ষ পেছনে পাস খেললেও প্রেসিং-এ যায়, বলের দখল ফেরত পেতে। আসলে, ডর্টমুন্ডেও ‘গেগেনপ্রেসিং’ নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে ক্লপ কিন্তু নিজেই দেখতে পেয়েছিলেন ৪-৩-৩ ছকের ছায়া, যেটা এখন লিভারপুলের খেলায় চমৎকারভাবেই ফুটে ওঠে।
ডর্টমুন্ডের রক্ষণাত্মক কৌশলের অন্যতম ছিল উইঙ্গারদের নীচে নেমে এসে রক্ষণকে সাহায্য করার পাশাপাশি বিপক্ষের পাস দেওয়ার জায়গা বন্ধ করে দেওয়া। বিপক্ষের আক্রমণের ঝাঁঝ এমনিতেই কমে যেত। লিভারপুলে ব্যাপারটা প্রোঅ্যাকটিভ অনেক বেশি। যদিও মাঝেমাঝে এই অল্প প্রেসিং থাকেই, লিভারপুল বরঞ্চ ‘গেগেনপ্রেসিং’ বেশি ব্যবহার করে নিজেদের ফাঁদে বিপক্ষকে ফেলার সময়।
তা ছাড়াও, লিভারপুল প্রেস করে ডর্টমুন্ডের চেয়েও উঁচুতে, মানে নিজেদের অর্ধের প্রায় শেষ দিকেই। উইঙ্গারের পা দিয়ে শুরু হয় নিজেদের প্রেসিং। বিপক্ষের সেন্টার ব্যাককে বাধ্য করে বলটা ভেতরের দিকে পেছনে খেলতে। এর ফলে বিপক্ষের আক্রমণের সম্ভাবনা শুরুতেই ব্যাহত হয়। যে-কারণে ডর্টমুন্ডের ৪-৪-১-১ বা ৪-৪-২ ছেড়ে লিভারপুল এখন অনেক বেশি নির্ভরশীল ৪-৩-৩ ছকে, যা সুবিধা করেছে ক্লপের দলকে, ‘গেগেনপ্রেসিং’ খেলতে ইংল্যান্ডেও।
এই প্রেসিং-এর ফাঁদে বিপক্ষের মিডফিল্ডারদের আটকে ফেলে অধিকাংশ সময়ই লিভারপুল ফেরত পায় বলের দখল, যেমন করেছিল ম্যাঞ্চেস্টার সিটির বিরুদ্ধে ফার্নানডিনহোকে। তবে শুধুই যে মাঝমাঠের মাঝখানে যে থাকবে তাঁর বিরুদ্ধেই এভাবে প্রেস করবে, এমন নয়। যে কোনও দিক থেকেই শুরু হতে পারে। এখানে বাড়তি গুরুত্ব থাকে ফুলব্যাকদের, যাঁরা নিজেদের ডিফেন্স-লাইন থেকে অনেকটা ওপরে থেকেও রক্ষণে সক্ষম। বিপক্ষ যদি সরাসরি তাদের রক্ষণে বল পাঠায়, নিজেদের তিনজন যেন প্রস্তুত থাকেন সবসময় সেই পরিস্থিতি সামলে দেওয়ার জন্য। এই কারণেই উইঙ্গারদের ক্রমাগত নীচে নেমে-আসা এবং মাঝমাঠের ফুটবলারদের রক্ষণে বাড়তি সাহায্য করাটাও জরুরি।
নাম্বার নাইন থেকে ফলস নাইন দেখুন, ফুটবলে সেই ফুটবলারকেই নির্দিষ্ট ভূমিকায় খেলাতে হয় যিনি সেই ভূমিকায় খেলতে পারেন। ক্লপ সেটা জানেন না ভেবে নেওয়াটা মূর্খামি। তাই ডর্টমুন্ডে রবার্ট লেওয়ানডোস্কিকে যদি তিনি ‘নাম্বার নাইন’ হিসাবে খেলিয়ে সাফল্য পেয়ে থাকেন, লিভারপুলে রবার্টো ফিরমিনোকে খেলাচ্ছেন ‘ফলস নাইন’ হিসাবে।
ডর্টমুন্ডে লেওয়ানডোস্কি ছিলেন ‘হোল্ড-আপ’ স্ট্রাইকার। লং বল যেত তাঁর জন্য, সবচেয়ে দূরবর্তী জায়গায়। সেই বল পায়ে পেয়ে কখনও লেওয়ানডোস্কি একাই বিপক্ষকে ধ্বংস করতেন, কখনও অপেক্ষা করতেন সতীর্থদের উঠে আসার জন্য। ডর্টমুন্ডের ভাবনাটা ছিল অনেকটাই ‘ডাইরেক্ট’, আর পোলিশ স্ট্রাইকারের দক্ষতাও বিবেচ্য, এই ধরনের খেলায়। আর উইং থেকে যে ক্রসগুলো আসত সেগুলোর জন্যও সমান বিপজ্জনক ছিলেন লেওয়ানডোস্কি।
লিভারপুলে সাদিও মানে আর মোহামেদ সালাহ বল পায়ে পেয়ে বিপক্ষ রক্ষণের দিকে দৌড়তে পছন্দ করেন যেমন, দৌড়নোর জন্য একটু পিছিয়ে থেকে বল পায়ে পেতে চান। তখন তাঁদের ওই দৌড়নোর জায়গাটা দিতে ফিরমিনো বেশিরভাগ সময় পিছিয়ে আসেন বিপক্ষ রক্ষণভাগ আর মাঝমাঠের ফুটবলারদের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায়, আদর্শ ফলস নাইন হিসাবে। সেখানে খেলা তৈরির দক্ষতাও কাজে লাগে ফিরমিনোর। একই সঙ্গে বিপক্ষের রক্ষণভাগের ফুটবলারদের টেনে নিয়েও আসতে পারেন তাঁর দিকে। নিজের ভাবনায় এই পরিবর্তন প্রমাণ করে দেয় যে, ক্লপ নিজের কৌশলের মতোই হাতে-থাকা ফুটবলারদের দক্ষতা সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল।
আক্রমণে বৈচিত্র্যই মূল কথা: লিভারপুলের মতো ডর্টমুন্ড খেলা তৈরির ক্ষেত্রে ততটা দক্ষ ছিল না। তাই দ্রুতগতির প্রতি-আক্রমণেই গোল হত বেশি। লিভারপুলকে বিপক্ষ খেলা তৈরির প্রয়োজনীয় সময় দেয়। ফলে, প্রতি আক্রমণে গেম বিল্ডআপে নিজেদের মতো করেই সময় নেয় লিভারপুল এবং অত্যন্ত জরুরি সেই খানিক অপেক্ষার পর নিজেরাই খুঁজে নেয় আদর্শ সময়টা, যখন আক্রমণে গিয়ে চরম অপ্রস্তুতে ফেলতে পারবে বিপক্ষকে। তাই আক্রমণের ক্ষেত্রেও নিজেকে পাল্টে ফেলেছেন ক্লপ, অ্যানফিল্ডে এসে।
ডর্টমুন্ডের যে কোনও একটা দিক ধরে আক্রমণে আসার সরু-পথ আগেই আলোচিত। লিভারপুল সেখানে অনেক বেশি জায়গা পাচ্ছে, মাঠের মাঝখানে। বার্সেলোনার বিরুদ্ধে সেই বিখ্যাত ম্যাচটা ভাবুন। মাঠের মাঝখানেই আটজন, নানা জায়গায় ছিলেন। শুধু দুই উইঙ্গার ছিলেন দুপাশের প্রান্তরেখা বরাবর। এর ফলে মাঝমাঠে সংখ্যাধিক্যও বজায় ছিল যেমন, মাঠের মাঝখান থেকে সাইডলাইনে সরে গিয়ে প্রয়োজনীয় জায়গাও পেয়েছিলেন নিজেদের গতি ব্যবহার করে দৌড়নোর। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডাররা এভাবে নিয়মিত বাইরে চলে যাওয়ার ফলে উইং ব্যাকরাও সুযোগ পান আরও ওপরে উঠে আসার। কোনও কোনও সময় এই জন্যই ক্লপের উইঙ্গাররা সরাসরি মুখোমুখি হয়ে যেতে পারেন বিপক্ষ স্টপারের, আবার ওই বাড়তি মিডফিল্ডারের উপস্থিতিতে প্রান্তরেখার দিকে নিজেদের দুজন পেয়ে যান বিপক্ষের মাত্র একজনকেই। এই বৈচিত্র্যের কারণেই লিভারপুলকে আটকানো বেশি কঠিন যেমন, লিভারপুলের আক্রমণের ধরনও আন্দাজ করা খুবই কঠিন।
ভার্জিল ভ্যান ডিককে সই করানোর পর গেম বিল্ডআপের সময় লিভারপুলের বৈচিত্র্য এখন অনেক বেশি। অস্বীকার করার কোনও জায়গাই নেই যে, ভ্যান ডিকের রক্ষণাত্মক দক্ষতা দুরন্ত। বিপক্ষের আক্রমণ আটকাতে পারেন অবলীলায়। নিজের উন্নততর টেকনিকের কারণে নিজেদের মধ্যে ছোট পাসে বিপক্ষের আক্রমণকে থামিয়ে হঠাৎই একটা কৌণিক বড় পাসে বিপক্ষের বিপজ্জনক অঞ্চলে আক্রমণকে সহজে পৌঁছে দেওয়াও সম্ভব, ভ্যান ডিকের কারণেই। আক্রমণভাগের তিনজন এর ফলে বাড়তি জায়গা পেয়ে যান, অথবা ফাঁকা জায়গায় বল পেয়ে যান পায়ে। বিপক্ষের মাঝমাঠেও শূন্যতা সৃষ্টি হয়, কারণ ডিফেন্ডাররা পছন্দ করেন পিছিয়ে থাকতে। ফলে নষ্ট হয় বিপক্ষের আক্রমণের ‘ভার্টিকাল কম্প্যাক্টনেস’।
ক্লপ আবার ট্যাকটিক্যাল সিস্টেমে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রেও সমান দক্ষ। চমকে দেওয়ার মতো ছোট ছোট উপাদান নিয়ে আসেন প্রায়ই। ধরুন হঠাৎই ৪-২-৩-১ ছকে চলে গেলেন, ফিরমিনোর সামনে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসাবে তখন থাকেন সালাহ। এই ভাবনাগুলোই তাঁকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ম্যানেজারের জায়গাটা এনে দিয়েছে।
ক্লপের ফুলব্যাকদের ভূমিকা: চার ব্যাকের তত্ত্বে বিশ্বাসী ক্লপ। ডর্টমুন্ডেও চার ব্যাকেই খেলেছিলেন, লিভারপুলেও তাই। কিন্তু পাল্টেছে ফুলব্যাকদের ব্যবহারের ধরন। এর কারণও দুটো। যাঁদের যাঁদের পেয়েছেন লিভারপুলে এবং ট্যাকটিক্যাল সিস্টেমে তাঁদের আক্রমণে কীভাবে ব্যবহার করবেন, সেটা একটা অন্য ভাবনা ক্লপের।
ডর্টমুন্ডে খেলাতেন ৪-২-৩-১, ডবল পিভট আর মাঝমাঠে একজন প্লেমেকার নিয়ে। ওই ডবল পিভটের একজন আক্রমণে সাহায্য করতে অনেকটাই উঠে যেতেন। অন্যজন থেকে যেতেন রক্ষণের ঠিক ওপরে। এর ফলে ডর্টমুন্ড রক্ষণে তিনজনের উপস্থিতি জরুরি ছিল। দুই সাইড ব্যাকের একজন, যাঁর দিক দিয়ে আক্রমণ হত, তিনি উঠে যেতেন আক্রমণের অংশ হতে। অন্যজনের ওঠা ছিল মানা সেই সময়ে, তিনি নিচে থাকতেন। ডর্টমুন্ড যেহেতু অনেকটাই ডাইরেক্ট খেলত, দুই উইঙ্গারই ভেতরে ঢুকে আসতেন আগেই। তাই দু'দিক দিয়ে আক্রমণে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতই না, তাড়াতাড়ি প্রান্ত পাল্টানো সম্ভব হত না, দু-প্রান্তে বল নেওয়ার লোক থাকত না। বল যে দিকে নেই সেই প্রান্তের সাইড ব্যাক ওপরে উঠতে পারতেন না, রক্ষণকে সাহায্য করার প্রয়োজনীয় লোক না থাকায়। ডানদিক ধরেই বেশি আক্রমণ হত তখন, লেফট ব্যাকের কিছু করার ছিল না নিজের জায়গায় থাকা ছাড়া।
এই সমস্যাটার সমাধান ক্লপ করে ফেললেন লিভারপুলে। ট্রেন্ট আলেকজান্দার আর্নল্ড আর অ্যান্ডি রবার্টসন দুই সাইড ব্যাককেই স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলেন। আক্রমণে ওঠার সময় দুজনেই হয়ে উঠলেন দুই প্রান্তের সবচেয়ে দূরবর্তী অংশ যাতে সালাহ আর মানে দুজনেই ভেতরে ঢুকে পড়তে পারেন অনায়াসে, যখন-তখন।
এই পরিবর্তন আবার তখনই সম্ভব যখন মিডফিল্ডাররা সাহায্য করতে নেমে আসবেন রক্ষণে। তাই ৪-৩-৩ ছকে একজন হোল্ডিং মিডফিল্ডার এবং দুজন আগুয়ান মিডফিল্ডার থাকলেন ক্লপের হাতে। দলের হাতে সুযোগ এল আক্রমণে বৈচিত্র্য বাড়ানোর, যে কোনও দিক দিয়েই। দুই আগুয়ান মিডফিল্ডার বারবারই পিছিয়ে যেতে শুরু করলেন সাইড ব্যাকদের ফেলে-আসা জায়গা সামলাতে। বিপদমুক্ত থাকল রক্ষণ, আবার সুবিধাও হল বল-ডিস্ট্রিবিউশনে। দুই সাইডব্যাক ওপরে থাকায় দুই উইঙ্গার যেমন ভেতরে ঢুকে আসার বাড়তি সুযোগ পেলেন, ফিরমিনোর ফলস নাইন ভূমিকাও কাজে লাগল বিপক্ষের অর্ধে। তাই, দুই সাইডব্যাকের পাঠানো ক্রস থেকে লিভারপুল অনেক বেশি সুযোগ তৈরি করতে শুরু করল, যা থেকে বাড়ল গোলের সম্ভাবনা এবং গোলও হতে লাগলো বেশি।
আলেকজান্ডার আর্নল্ড, এই রাইটব্যাকের নাম রয়েছে এই ২০১৯-২০ মরসুমে ১২টি গোলের ‘অ্যাসিস্ট’ তালিকায়, লেফটব্যাক রবার্টসনের সাতটি। গেগেনপ্রেসিং-এর মূল তত্ত্ব যদিও পাল্টায়নি কিন্তু বিরাটভাবেই পাল্টে গিয়েছে দুই সাইডব্যাকের ভূমিকা। তাঁর নতুন প্লেমেকার হিসাবে উঠে এসেছেন দুজন সাইড ব্যাক।
সিদ্ধান্ত: মোদ্দা কথা, ক্লপ নিজের দর্শন পাল্টাননি, কিন্তু, নিরন্তর চালিয়ে গিয়েছেন বদলে দেওয়ার ভাবনা। পরিবর্তন এসেছে তাঁর আক্রমণের বৈচিত্র্যে। তাঁর দল ক্রমশ নিজেদের উন্নীত করেছে আরও বিপজ্জনক হিসাবে। এটাই লিভারপুলের বর্তমান সাফল্যে ক্লপের অবদান। সেইজন্য কৃতিত্ব দিতে হবে ক্লপের নিরন্তর নিজেকে উন্নততর করার প্রচেষ্টাকেই। সেট পিস কাজে লাগাতে চেয়ে থ্রো-ইন বিশেষজ্ঞও এনেছেন। তাই ক্লপের ট্যাকটিক্যাল বিবর্তন যে এখানেই শেষ, ভাবার কোনও কারণ নেই। উন্নততর ক্লপকে দেখতে পেতেই পারেন, আগামী দিনেও।