পৌলমীর মত কাহিনী বাংলার ফুটবলে ঘরে ঘরে

অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় পৌলমী অধিকারীকে নিয়ে প্রচুর মেসেজ আসছে। ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে। সবাই ওর ভিডিও শেয়ার করে বলছেন, একী লজ্জা। কিছু একটা করুন। যেন প্রথমবার এরকম কিছু একটা হল। আমাদের কলকাতাতেই কত অটো-টোটোচালক কিংবা সবজিবিক্রেতা যে একসময়ের সম্ভাবনাময় রাজ্যস্তরের খেলোয়াড় তার ইয়ত্তা নেই। গ্রামগঞ্জ খুঁজলে তো আরও। তাদের অবশ্য প্রতিভা চেনানোরও কোন সুযোগ থাকে না। আচ্ছা, পৌলমীরা করবে কী! ফুটবল খেলে তো এখন আর চাকরি হয় না। অনেক বছর হয় না। কেউ খোঁজখবরও রাখেন বলে মনে হয় না। আর সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে ভাবারও সময় নেই কারও।
একটা ভিডিও এসেছে, বেশ দুঃখ দুঃখ লেগেছে, শেয়ার করে দাও। তবু ভাল যদি এই লাইক, কমেন্ট, শেয়ারে পৌলমীর গল্প আসল সমস্যাটাকে সামনে আনে। আনবে না, সেটাও নিশ্চিত থাকুন। ফেসবুকের অ্যালগোরিদম অনুযায়ী ভিডিওটা ভাইরাল হওয়া বন্ধ হলেই মানুষের এই অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণেরও ইতি। কতই তো দেখলাম। ভারতীয় ফুটবল পেশাদারি ফুটবলের দিকে এগিয়েছে। ফুটবল খেলে এখন বছরে এক কোটিরও বেশি আয় করছে একজন ভারতীয় ফুটবলারও। কত বাঙালি ফুটবলারও এখন কোটিপতি। সেটা জানেন? সমস্যাটা অন্য জায়গায়। রিলায়েন্স কিংবা আর পি জি, ইমামি, জিন্দালদের মত কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ গ্রাসরুট স্তরটায় পৌঁছায় না। পৌলমীদের অবধি পৌঁছায় না। ভারতীয় ফুটবল দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে আই এস এল, অন্যদিকে পৌলমীদের ফুটবল।
বাংলা দল এবার সন্তোষ ট্রফি খেলতে গেছে ডিটিডিসি-র সি এস আর ফান্ড নিয়ে। সংস্থার মালিক শুভাশিস চক্রবর্তী একসময় ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতেন। সেই নস্টালজিয়া থেকে কিছুটা অনুকম্পা। ফুটবল ঘিরে কোন বানিজ্যিক সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া নয়। তাই আই এস এল-এর বাইরের ফুটবলটা আসলে এমন। কাউকে কোন দোষ দিয়ে লাভ নেই। আগে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো ভালো খেলোয়াড়দের চাকরি দিত। এখন নিজেরাই মাইনে দিতে পারে না ভালো করে, তারপর আবার খেলোয়াড়দের দায়িত্ব!! যে সমস্ত সরকারী সংস্থাগুলো এদের চাকরি দিত, খেলোয়াড় জীবনে অবসরের পর এদের জাস্ট বাড়তি বোঝা ভেবেছে।
একজন ফুটবলার কিংবা অ্যাথলিট অত্যন্ত দক্ষভাবে সরকারি ফাইল মেইনটেইন করবেন, সেটা তো সম্ভব নয়। তাদের যেভাবে ব্যবহার করা যেত, যেভাবে এই সংস্থাগুলো তাদেরকে একটা প্রজন্ম গড়ার কাজে ব্যবহার করতে পারত, ভাবেইনি কোনদিন। আসলে কী জানেন, খেলাধূলাটা একটা সংস্কৃতি, একটা বেঁচে থাকা, জীবনের উদযাপন। চার বছর অন্তর বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় মরসুমি সমর্থক হয়ে গেলাম, ক্রিকেটার দেখলেই আদিখ্যেতায় গলে আইসক্রিম হয়ে গেলাম, আর পৌলমীর দুঃখের ভিডিও দেখলে এদেশের এক হতভাগ্য ফুটবলারের জন্য দু'চোখ থেকে জলের ধারা নামল, সবটাই বাঙালির হুজুগেপনাই। আমরা কোনদিন খেলাধূলার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসই করিনি।
এই যে কৃতী বাঙালি খেলোয়াড়রা একের পর এক রাজ্য ছেড়ে গিয়ে অন্য রাজ্যের হয়ে অংশগ্রহণ করে জাতীয় প্রতিযোগিতায়, আমরা তাদের কোন খোঁজ নিয়েছি!! কেন চলে যায়, কতটা চোখের জল নিয়ে তাদের রাজ্য ছাড়তে হয়, প্রশ্ন তুলেছি একবারও! পৌলমীকে আমি বরং অনেক লাকি বলব যে সম্মানের সঙ্গে পেশাদার জীবনে পা দিতে পেরেছে। ফুটবল ওকে পৃথিবী দেখিয়েছে, কনফিডেন্স দিয়েছে। সেই কনফিডেন্সটা ওকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে এখান থেকে। লজ্জা নয়, বরং বলুন ফুটবল খেলার জন্যই একটা মেয়ে সাহসী হয়ে মোকাবিলা করছে এই দুনিয়ায়। সাহসী হয়ে, সম্মানের সঙ্গে পা রেখেছে পেশাদারি জগতে। সবাই পেশাদার ফুটবলার হবে, সেটা তো হয়না। বরং ফুটবল মাঠ ওকে শিখিয়ে দেবে প্রতিদিন কী করে সব প্রতিকূলতাগুলো ড্রিবল করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়!!
নতুন জীবনের এই সংগ্রামের মাঠে স্বাগতম পৌলমী। খেলোয়াড়দের কোন অনুকম্পার দরকারই হয় না। এগিয়ে চলো।