দোহা আসলে 'লন্ডন' ছাপিয়ে যেতে চায়, আর আমরা!!

অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়, কাতার : ছোটবেলায় ঝুলন সাজিয়েছেন কখনও? ঘাসের চাঙ্গর কেটে বানিয়ে নেওয়া খেলনা পাহাড়, আর তার নিচে থেকেই নামত রাস্তাটা। রাস্তাটা সোজা নেমে নদী পেরিয়ে মরুভূমিতে ঢুকত। দু'পাশে বালির আয়তক্ষেত্র আর তার বুক চিরে বেরিয়ে আসা কালো রাস্তা। লুসাইল হয়ে রাস্তাটা স্টেডিয়ামে ছাড়িয়ে যখন আল খোরের দিকে যাচ্ছিল, বারবার আমার সেই সাজানো ঝুলনের কথা মনে হচ্ছিল। দু'পাশে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, আর তার মাঝ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া একটা রাস্তা। যেন অনন্ত যাত্রাপথ। দোহায় আসার পর কয়েকদিন আল খোর-এই ছিলাম। একটা হোটেলে। কিন্তু দোহার সঙ্গে দূরত্বটা এত বেশি বুঝতে পারিনি। আমাদের মিডিয়া সেন্টার থেকে রাতের কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রোজ প্রায় ভোররাত। বিকল্প আস্তানা পেয়ে গেলাম।
কলকাতা থেকে আসার আগেই ফোন নম্বর পেয়েছিলাম সঞ্জয়দার। সঞ্জয় রায়চৌধুরি, দোহার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বুকে গোটা একটা কলকাতা নিয়ে বসে নতুন দোহা রূপায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কাতার সরকারের সঙ্গে। সঞ্জয়দার সঙ্গে যোগাযোগ করালেন আমাদের মাতৃসংঘ জনকল্যাণ আশ্রমের বাবুয়াদা, প্রশান্ত ঘোষ। বাবুয়াদা প্রাক্তন ক্রিকেটার। সঞ্জয়দাও তাই। বাবুয়াদার একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজই আমার সমস্যা সমাধানের পাসওয়ার্ড হয়ে গেল। সঞ্জয়দা বললেন, 'আমার একটা ফ্ল্যাট আছে। শহরের মাঝখানে। ফাঁকাই পড়ে। ওখানে থাকুন।' তারপর থেকে আমার ঠিকানা দোহার প্রাণকেন্দ্রে। জায়গাটার নাম উমগওয়ালিনা। তালিচাবি দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকি, বের হই। এই কয়েকদিনে সঞ্জয়দা আপনি থেকে 'তুমি'-তে চলে এসেছে। কাজের বাইরে আমরা কয়েকদিন দেদার আড্ডা মেরেছি, চুটিয়ে খেয়েছি। হামুস থেকে মোচা ঘণ্ট, কোন কুইজিনটা আর বাদ আছে! কলকাতা ফিরে ফিরে এসেছে আমাদের আলোচনায়। কখনও সৌরভ গাঙ্গুলি, কখনও যাদবপুর ইউনিভার্সিটি, ময়দানের মাঠ, উৎপল গাঙ্গুলি, সম্বরণ ব্যানার্জি, সুভাষ ভৌমিক, সুব্রত ভট্টাচার্য- কে নেই সেই আড্ডায়। আর আপশোস করেছি, ইস দোহা পারলে আমরা পারি না কেন! এর সহজ উত্তর আছে একটা।
পেট্রো ডলারের পয়সা, কাতার পারবে না তো কে পারবে! তারপরই নিজের ধ্যানধারণা, বোধকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করেছে, মাত্র ৩০ লাখ লোকের দেশ, ৩ লাখ নিজের দেশের, বাকি ২৭ লাখ বিদেশ থেকে ভাড়া করে আনা মানব সম্পদ- তাতেও কি উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেওয়া যায়! শুধুই কি ডলার, সদিচ্ছা কোনও অনুঘটকই নয় দেশ গঠনের এই কর্মযজ্ঞে! প্রাকৃতিক সম্পদ, মানব সম্পদ সবটা তো আমাদের দেশেও ছিল নেহাত কম নয়, তারপরও কেন ৩ লাখের কাতার যা পারে, ১৩০ কোটির ভারত তা পারে না। উন্নয়নের মাপকাঠি প্লিজ রাস্তাঘাট কিংবা কয়েটা স্টেডিয়াম, শপিং মল ভাববেন না। অর্থনীতিতে উন্নয়নের মাপকাঠিতে অনেক কিছু ধরা হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শিশু মৃত্যুর হার থেকে সামাজিক, বনসৃজন সবটা থাকে ওই ইনডেক্সে! আমি এখানে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা উদাহরণ দিই। কাতারকে বলা হচ্ছে, এই মুহুর্তে পৃথিবীর অন্যতম নিরাপদ দেশ। ক্রাইমের শতকরা হার? শূন্য। স্থানীয়রা বলছেন, বাসস্ট্যান্ডে মোবাইল ফেলে যান, পরদিন ঠিক একই জায়গায় কুড়িয়ে পাবেন। এতই নিরাপদ! মহিলারা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। রাত তিনটে অবধি এখানে মেট্রো কিংবা বাস চলে। মেয়েরা ফেরেন নিরাপদে। এই কয়েকদিন মেট্রোয়, বাসে, মিডিয়া সেন্টারে অনেক মহিলা সহযাত্রী কিংবা সহকর্মীর সঙ্গে কথা হল। কেউ কেরলের, কেউ কেনিয়ার, কেউ আবার ফিলিপাইন্সের মেয়ে। চাকরি করেন। ৭-৮ বছর কিংবা তার বেশি সময় ধরে আছেন কাতারে। মুক্তকন্ঠে এদেশের প্রশংসা করছেন। কেনিয়ার মেয়ে শি, এখানে চাকরি করে। বিশ্বকাপের সময় ভলেন্টিয়ারি সার্ভিস দিচ্ছে। মিডিয়া সেন্টারেই কাজ সামলাচ্ছে। বলল, 'আমার নিজের দেশেও আমি এতটা সেফ নই, যতটা এখানে সেফ।' ভারতীয় মেয়েদেরও একই কথা। এতটুকু নিরাপদহীনতায় ভুগতে হয় না। যত রাতেই বাড়ি ফেরে না কেন!
আর নিজেদের দেশের সেফটির কথা তো না তোলাই ভাল! স্বাস্থ্য এখানে ফ্রি। হ্যাঁ, ফ্রি। সে আপনি কাতারের নাগরিকই হোন, কিংবা এদেশের অতিথি। দোহার মাঝেই হেলথ সিটি। পরপর সরকারি হাসপাতাল, রিসার্চ সেন্টার। পৃথিবীর সেরা চিকিৎসক থেকে ইনফ্রাস্ট্রাকচার- সব পাবেন। রোবোটিক সার্জারি থেকে নিত্যনতুন গবেষণা, সব হচ্ছে। আমার স্ত্রী দোহায় খেলা দেখতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডে কেয়ারের দরকার ছিল। বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় যাব! সঞ্জয়দাকে বললাম। সঞ্জয়দার অফিস থেকে লোক এসে গেল। ওরা ডাকল অ্যাম্বুলেন্স। ঠিক দু'মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স হাজির। যতক্ষণ না অ্যাম্বুলেন্স এল, জরুরি পরিষেবার হেল্পলাইনের লোক ফোন ধরে থাকল। প্রশ্ন করতে থাকল, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না তো? কী সমস্যা হচ্ছে? বারবার। অ্যাম্বুলেন্স এল, অত্যাধুনিক। হাসপাতালে ঘণ্টা তিনেক থাকতে হল। বিনা পয়সায়। শুধু ওষুধ কিনতে হল। দাম? ২ কাতারি রিয়্যাল। অর্থাৎ এই ৪৪-৪৫ টাকার মতো। হেলথ সিটির মতো এখানে তৈরি হয়েছে এডুকেশন সিটি আর স্পোর্টস সিটি। এডুকেশন সিটিতে রয়েছে বিশ্বের সব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। গোটা দুনিয়া থেকে ছাত্রছাত্রী পড়তে আসছে এখানে। আমাদের যেখানে মিডিয়া সেন্টার হয়েছে, সেটা দোহা ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার। এত বড় যে বাড়ির এক দিক থেকে অন্যদিকে পৌঁছতে ১৫ মিনিট সময় লাগে। বিশ্বাস করুন, এক বিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। যেখানে থেকে আমাদের স্টেডিয়াম যাবার বাস ছাড়ে, সেখানে যাবার জন্য আমরা ১৫ মিনিট আগে ওয়ার্কিং এরিয়া থেকে বেরিয়ে যাই। এখানেই হয়, দোহার যাবতীয় কনভেনশন। উল্টোদিকেটই কাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি। প্রথম দিন গেছিলাম ওখানে। ১০ লাখ বই আছে ওখানে। বিল্ডিংয়ের স্ট্রাকচারটা হল, যেন একটা বই ওল্টানো আছে। ভিতরে বই রাখার স্টাইলটা গ্যালারির মতো। প্রতিটা রো-এ বই। শুধু পৌঁছে যেতে হবে। প্রচুর কাতারি মহিলা, শিশুদের দেখলাম বসে বসে বই পড়ছে। আসলে শিক্ষার একটা রেওয়াজ না থাকলে উন্নয়নকে খড়্গহস্তেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শিক্ষা চাই, প্রবলভাবেই চাই। স্পোর্টস সিটিটা ম্যানেজ করে অ্যাসপায়ার নামের একটা কোম্পানি। এখানেই খলিফা স্টেডিয়াম। পাশেই অ্যাসপায়ার স্পোর্টস আকাডেমি। এটা একটা ইনডোর স্পোর্টস ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ভিতরে সব পাবেন। ফুটবল স্টেডিয়াম, বাস্কেটবল কোর্ট, ক্রিকেট পিচ, ফুটবল জোন, টেবিল টেনিস এরিনা- সব। সবটা ইনডোরে। গরম কালে দোহার তাপমাত্রা দিনের বেলায় পৌঁছে যায় প্রায় ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। রাতে ৩৫-৪০ ডিগ্রি থাকে। এই গরমে খেলা সম্ভব নয়। তাই এই সব জায়গাই এয়ার কন্ডিশনড। কাতারে এই সমস্ত স্টেডিয়াম শীততাপ নিয়ন্ত্রণ করে কাতার কুল নামের একটা সংস্থা। মানে, এসিও চলে জল, ইলেকট্রিসিটি কিংবা গ্যাসের মতো। কাতার কুল থেকে কানেকশন আসে স্টেডিয়ামগুলোয়। সেখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় তাপমাত্রা। পাশেই বিরাট অ্যাকোয়েটিকা এরিনা।
২০০৬-এ দোহা এশিয়ান গেমসে সুইমিং, ডাইভিং, ওয়াটারপোলো হয়েছিল এখানে। তারপাশে হোটেল ফ্লেমস। বিশাল গোলাকার হোটেলের মাথায় ছিল এশিয়ান গেমসের মশাল। নিশ্চিত থাকুন, আগামী দিনে অলিম্পিক মশালও এখানে থাকবে। কাতার সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছে। গোটা দেশকে ২০২৪-এর মধ্যে বদলে দেওয়া হবে, সরকারি পরিকল্পনা ছিল এটা। বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন এই পরিকল্পনার একটা অংশ মাত্র। ওদের পরের স্টেশন, ভিশন ২০৪০। এই পরিকল্পনায় আছে অলিম্পিক। যে দেশ একটা শহরের মধ্যে একটা বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করতে পারে, তারা সব পারে। স্পোর্টস সিটির আরও অনেক পরিকাঠামোর মাঝে অন্যতম অ্যাসপেটার হাসপাতাল আর নাডার হেড অফিস। অ্যাসপেটার হল স্পোর্টস মেডিসিনের জন্য গোটা একটা হাসপাতাল। পৃথিবীর সেরা ক্রীড়াবিদরা এখন আঘাতের চিকিৎসায় চলে আসেন অ্যাসপেটারে। লিওনেল মেসি যেমন। অপারেশন করিয়ে গেছেন এখানে। আর নাডার অ্যান্টি ডোপিংয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণাগার আর অফিসও এখানে। রয়েছে স্পোর্টস মিউজিয়াম, হাই পারফরমেন্স সেন্টার- কী নেই! জুভেন্তাস, লিভারপুল, বায়ার্নের মতো দলগুলো তাই প্রস্তুতি নিতে আসছে এখানে। এই পরিকাঠামো কী আর কেউ ছাড়ে!
অনেকদিন আছেন এখানে, তাঁরা বলেন, শেষ ১০-১২টা বছরে গোটা দেশটা বদলে দেওয়া হল। এই যে লুসেইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ফাইনাল হবে, ওই জায়গাটাই তৈরি করা হল গত কয়েক বছরের মধ্যে। মানে এই অঞ্চলটা দোহার নতুন উপনগরী বলতে পারেন। আমাদের রাজারহাট-নিউটাউনের মতো। আর একেবারে অত্যাধুনিক শহর। এখানে পার্কগুলোও এয়ার কন্ডিশনড। রাস্তার মাঝে মাঝে পাবেন এয়ার কন্ডিশনড সিস্টেম। অঞ্চলটাকে ঠান্ডা রাখছে। আর বিরাট একটা কর্মযজ্ঞ চলছে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নিয়ে। এই যে স্টেডিয়ামগুলো দেখছেন কিংবা ফ্যান জোন, তার নিচে থাকছে ওয়াটার রিজার্ভার বক্স। সঞ্জয়দার কোম্পানি এই পরিকাঠাম তৈরির কাজে প্রবলভাবে জড়িয়ে ছিল। সমুদ্রের জল বলুন, কিংবা কাতার শহরের বৃষ্টির জল, কোনওটা নষ্ট হয় না। জল স্টোর করা হয়। সমুদ্রের জলে বিভিন্ন পদ্ধতিতে লবণটা বার করে শহরে সরবরাহ করা হয়। বৃষ্টির জল যায় পার্কের গাছ কিংবা সবুজ রক্ষণাবেক্ষণে। আর এই ধরনের আধুনিক শহরের বর্জ্য পদার্থটা টেনে আনা হয় সাকশন পদ্ধতিতে। অর্থাৎ এয়ার ভ্যাকুয়ামেই টেনে নেওয়া হয় বর্জ্যটা। জলের অপচয় বন্ধ করা যায় যেভাবে। মরুভূমির মধ্যে এভাবেই ওরা সবুজ আর জল বাঁচানোর জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। কারও অনেক থাকে, তারা অপচয় করে। আর এরা এক টুকরো সবুজ পেয়ে প্রাণপনে বাঁচিয়ে রাখেন!
দোহার আরও একটা অন্যতম আকর্ষণ পার্ল আইল্যান্ড। এটা আসলে একটা কৃত্রিম দ্বীপ। অভিজাত মানুষরা থাকেন। ছবির মতো সাজানো একটা জায়গা। রাস্তার দু'ধারে সারি ল্যাম্বারগানি কিংবা রোলস রয়েস দাঁড়িয়ে। পাশেই আরবিয়ান সি। শ'য়ে শ'য়ে ইয়র্ট দাঁড়িয়ে। ব্যক্তিগত প্রমোদতরী ভাসিয়ে দোহার অভিজাত সম্প্রদায় যায় সবুজ জলে প্রমোদে। সাধারণ মানুষও ভাড়া নিয়ে যেতে পারবেন। পুরো দ্বীপটা ভেনিসের মতো ক্যানাল দিয়ে সংযুক্ত। তাতে ওয়াটার ট্যাক্সি চলে। সবটা জাস্ট ছবির মতো। সঙ্গে আধুনিক জীবনের সব পরিষেবা। সবটা শুধু ডলারের হয়! হয় না। সঙ্গে নিজের দেশকে ঘিরে মারাত্মক ভালবাসা আর প্যাশন লাগে। গর্ববোধ লাগে। এই তো এখান আসার আসে পরিযায়ি শ্রমিকদের নিয়ে এত কথা, পশ্চিমী মিডিয়া লিখল, কলকাতার এক বিখ্যাত চিকিৎসককেও সেদিন বলতে শুনলাম, এখানকার শ্রমিকদের নাকি মারা গেলে বালিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বকাপের উদ্বোধনের দিন থেকে ভারতীয়, বাংলাদেশি বহু শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ একটা অভিযোগ করেনি। বরং প্রত্যেকে প্রবল খুশি। এখানে শ্রম মন্ত্রক এতটাই কঠোর যে কোনও ভেন্ডার কিংবা কনট্রাক্টর যদি কোনও শ্রমিকের প্রাপ্য পারিশ্রমিক না দেয়, তাহলে কাজ বন্ধ করিয়ে দেয় লেবার মিনিস্ট্রি। এতটাই কড়া অনুশাসন এখানে। এদের পারিশ্রমিক ভাল। মানে, দেশে যে টাকা 'রোজ' হিসেবে পেতে পারত, তার চেয়ে তো কয়েক'শ গুণ ভাল। চিকিৎসা ব্যবস্থা ফ্রি। থাকার ব্যবস্থা সবটা কোম্পনিকেই করতে হয় এবং সে সব একটা মানুষের থাকার ন্যূনতম চাহিদাটুকু মাথায় রেখেই। আল বেইট স্টেডিয়ামে উদ্বোধনের দিন দেখি, হাজার হাজার শ্রমিক বসে আছেন স্টেডিয়ামের বাইরে। তাদের বিশ্বকাপ দেখার টিকিট দেওয়া হবে সেদিন। যাঁদের হাতে বানানো স্টেডিয়াম, তাঁদের বঞ্চিত করেনি কাতার সরকার। ক'টা দেশ এরকম ভাবে! নিজের দেশ ভাবে! যে দেশগুলো থেকে ওঁরা এসেছেন এখানে! আর শ্রমিক মৃত্যু? গত ১০টা বছর ধরে এত কাজ, এত কিছু- কিছু দুর্ঘটনা কি হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। কাতার সরকার স্বীকার করেছেন। তা বলে, ৬ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু! বালিতে পুঁতে দেওয়া!
বাড়তি উদ্দীপনা, একটা দেশের নিয়মকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ না জানালে বিশ্বকাপে আসা কোনও দর্শকের পোশাক কিংবা কোনও আচরণ নিয়ে প্রশাসন মাথা ঘামিয়েছে বলে জানা নেই। ব্রাজিল ফ্যানরা মাঠে আসছেন তাঁদের মতো, তাঁদের পোশাকে। আর্জেন্টিনার ফ্যানরা সেলিব্রেশন সারছেন নিজের নিয়মে। মেট্রো কিংবা ফ্যান জোনে পশ্চিমী দুনিয়া তাঁদের অভ্যস্ত পোশাকেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অন্যান্য বিশ্বকাপে যেভাবে দেখা যায়, সেভাবেই স্লোগানে সেলিব্রেশনে মাতিয়ে দিচ্ছেন চারপাশটা- বরং বাড়তি পাওনা গোটা বিশ্ব জুড়ে হয়েছে একটা শহরে। আর শহরটা এতটাই তৈরি যে প্রায় ১৫ লাখ বাড়তি মানুষের দায়িত্ব সামলে দিচ্ছে অনায়াসে।
বাঙালি বাস্তুকার, বাঙালির হাতে গড়া কোম্পানি, ভারতীয় টেকনিসিয়ান- এঁরা সবাই মিলে একটা শহরের 'হোলিস্টিক' পরিবর্তন যখন করে ফেলতে পারেন, তখন আমাদের দেশের কিংবা দেশের কাজে ওঁরা লাগেন না কেন? সঞ্জয় রায়চৌধুরির মতো মানুষরা বলছেন, 'ডাকলে নিশ্চয়ই যাব। নিজের দেশ, নিজের শহর নিয়েই তো বাঁচি এখানেও।' সঞ্জয়দা নিজে হাওড়ার একটা কোম্পানির কাছ থেকে ম্যানহোলের কভার, ওয়াটার পিটের কভার এসব নিয়মিত নিয়ে আসেন। মুম্বইতে তাঁর প্রোডাকশন ইউনিটও কাজ করছে। যতটুকু দেশের সঙ্গে, রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যায়- সেটুকুই তাগিদ আর আনুগত্যে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ডাকব কে! নিজের দেশে বসে আমার নিজেরও অনেক সময়ই মনে হয়েছে, এ সব সফল বাঙালিরা নিজের রাজ্যের জন্য বিনিয়োগ আনতে পারে না! আর কতদিন ডিউটি ফ্রি থেকে ব্ল্যাক লেভেল কিংবা মার্লবোরা এনে নিজেদের দায়বদ্ধতার জায়গাটা ম্যানেজ করে যাবে! কিন্তু এখানে এসে, এই প্রান্ত থেকে নিজের রাজ্যের ছবিটার দিকে তাকালে আর অভিযোগ করতে ইচ্ছে করে না বিশ্বাস করুন। গোটা পৃথিবীটা এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষ কৃত্রিম দ্বীপ বানাচ্ছে। সবুজ বাঁচাতে, জল বাঁচাতে লড়ছে। নিজের শহর থেকে, প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার দূরের একটা শহরে বসে সবটা দেখছি আমরা, আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কে এবিপি আনন্দ কিংবা রিপাবলিকের নোটিফিকেশন আসছে, গাজোলে সংঘর্ষ, ভগবানগোলায় বিস্ফোরণ, এখানে বোমা কারখানা, ওখানে খুন। গোটা দুনিয়ায় কোথায় কী হল, কীভাবে বদলে যাচ্ছে এই পৃথিবীটা, তাতে এই রাজনৈতিক কারবারিদের কী যায় আসে! তাদের ক্ষমতা পেতে হবে, অর্থ পেতে হবে। আর এই কিছু রাজনৈতিক ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত ক্ষমতার লাভ লোকসানের বিস্তৃত ধারাভাষ্যে দেবে আমাদের মিডিয়া। তার বাইরে তাদেরও কি দেওয়ার কিছু ছিল না!
আসলে আমাদের বাংলা সিরিয়া হতে চায়, কাতার নয়!