এক্সক্লুসিভ: করোনা পরবর্তী ক্রিকেট শুরু হওয়ার পর কীভাবে সেলিব্রেশন করবেন? কী বললেন মহম্মদ সামি? জানতে পড়ুন...

সব্যসাচী বাগচী: দেশ জুড়ে চলতে থাকা লকডাউনের সময় প্রতিদিন নিয়মকরে তিনটি কাজ করেন। সকালের দিকে দুই ভাইরের সাথে জমিয়ে ফিটনেস চর্চা। একটু বেলা হলেই স্থানীয় এলাকায় ঘুরে ঘুরে ত্রাণের কাজ করা। এবং সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এসেই একেবারে 'প্রাইমটাইম'এ ইনস্টাগ্রাম শো। এভাবেই সময় কাটাচ্ছেন মহম্মদ সামি। তবুও এত ব্যস্ততার মাঝেও শনিবার এক্সট্রাটাইম'এর জন্য সময় বের করলেন 'সহেশপুর এক্সপ্রেস'। একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এল করোনা পরবর্তী ক্রিকেট, বলে থুতু ব্যবহার নিয়ে নিষেধাজ্ঞা। শুধু তাই নয়। তাঁর জীবনে দুই অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি ও বিরাট কোহলির প্রভাব। আসন্ন অস্ট্রেলিয়া সফরের খুঁটিনাটি থেকে শুরু প্রাণের প্রিয় কন্যা ছোট্ট আইরা'কে কাছে না পাওয়ার হতাশা। সবকিছু নিয়েই মুখ খুললেন টিম ইন্ডিয়ার স্পিডস্টার। টেলিফোনিক কথপোকথনে যেন অন্য এক মহম্মদ সামি'র পরিচয় পাওয়া গেল…..
প্রশ্ন) লকডাউনের সময় কীভাবে ট্রেনিং করছেন? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে দলের সঙ্গে ট্রেনিং করতে না পারা কতটা কঠিন?
মহম্মদ সামি) দেখুন সত্যি বলতে বিসিসিআই কিংবা আইসিসি'র তরফ থেকে ট্রেনিং ও ফিটনেস চর্চা নিয়ে তেমন কোনও নির্দেশিকা আসেনি। তবে করোনা ভাইরাসের সময় কি কি করা উচিত সেই বিষয়ে বোর্ড থেকে অবশ্যই জানানো হয়েছে। আর ট্রেনিংয়ের কথা যদি বলেন, নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ট্রেনিং তো করতেই হবে। কিন্তু আবার বলছি, দলের সঙ্গে ট্রেনিং ও একা ফিটনেস চর্চার আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। দলের একজন পেশাদার ফিটনেস ট্রেনার আছে। সেখানে একাধিক সরঞ্জাম আছে। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকলে সেই সুবিধা পাই। তবে একা ট্রেনিং করলে এই সুবিধাগুলো তো পাওয়া যায় না। ফলে একটু আলস্য তো চলেই আসে। এটা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। তবুও গত এক-দেড় মাসে টিম ম্যানেজমেন্টের শিডিউল ও নির্দেশ অনুসারেই ফিটনেস চর্চা করছি। যেভাবে আমরা আগে ট্রেনিং করতাম, সেভাবেই নিয়মিত শরীরচর্চা করছি। তাছাড়া আমাদের একটা হোয়াটসআ্যপ গ্রুপও আছে। সেখানেও সারাদিন ধরে এগুলো নিয়েই আলোচনা হয়। ইনস্টাগ্রাম লাইভেও সতীর্থদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়।
প্রশ্ন) করোনা পরবর্তী ক্রিকেটে বলের ব্যবহার নিয়ে আইসিসি একাধিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই অবস্থায় রিভার্স সুইং করিয়ে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করা কতটা কঠিন?
মহম্মদ সামি) আমরা ছোটবেলা থেকে থুতু দিয়ে বল পালিশ করতে অভ্যস্ত। পেস বোলারদের এটা একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু তাও আমি বলব, শুকনো বলের একটা দিকে যদি পালিশ ঠিক রাখা যায়, তা হলে বল ঠিক রিভার্স সুইং করবে। যদিও ব্যাপারটা কথায় সহজ হলেও, কাজে বেশ কঠিন হতে চলেছে। তবে নিয়ম তো মানতেই হবে। বল বানানোর জন্য আমরা ছোট থেকেই থুতু কিংবা কপালের ঘাম ব্যবহার করে এসেছি। তবে করোনা পরবর্তী নতুন নিয়মে থুতু ব্যবহার করা যাবে না। তাই এটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ, থুতু দিয়ে বল পালিশ করতে না পারলে সেটা কখন রিভার্স সুইং হবে, বলের গতি কতটা বাড়বে এগুলো দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তাই ওই পরিস্থিতির মধ্যে কয়েকটা ম্যাচ না খেললে ব্যাপারটা বোঝা বেশ কঠিন।
প্রশ্ন) রিভার্স সুইং'এর প্রসঙ্গ উঠলে এই মুহূর্তে সবার আগে আপনার নাম আসে। করোনা পরবর্তী অধ্যায়ে নিজের পুরনো ফর্ম কত দ্রুত ফিরে পাবেন?
মহম্মদ সামি) কোনও না কোনও রফা ঠিক বেরিয়ে আসবেই। বোলারদের জন্যও তো কিছু থাকতে হবে। সেটা না হলে তো যাবতীয় ব্যাপারটা একপেশে হয়ে যায়। থুতু দিয়ে বল পালিশ বন্ধ করা হলে রিভার্স সুইং করাতে সমস্যা হবে। এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। তবে বোলারদের বাঁচতে হলে কোনও উপায় বের করতেই হবে।
প্রশ্ন) করোনা পরবর্তী ক্রিকেট শুরু হওয়ার পর ব্যাটসম্যানকে আউট করার পর কীভাবে সেলিব্রেশন করবেন?
মহম্মদ সামি) দেখুন বিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের আউট করার পর সতীর্থদের সঙ্গে 'হাই ফাইভ' করা কিংবা তাঁদের জড়িয়ে ধরা তো সেলিব্রেশনের অঙ্গ। যুগ যুগ ধরে এভাবেই ক্রিকেট খেলা হয়েছে। তাই এগুলো তো অবশ্যই হবে। আর সেটা করতে হলে কোনও সিরিজের আগে দল নির্বাচনের পর সেইসব ক্রিকেটারদের করোনা পরীক্ষা করা খুব জরুরি। সেটা হলেই তো সমস্যা মিটে গেল। এতে বাছাই করা ক্রিকেটাররাও নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে। সতীর্থদের স্বাস্থ্য নিয়ে তাঁদের মনে কোনও সন্দেহ থাকবে না। তাই আমার মতে ব্যাপারটা এভাবে দেখলে সবার জন্যই ভাল। এতে ক্রিকেটের পুরোনো সংস্কৃতি মেনেই সবকিছু হবে। এবার যদি তারপরেও কেউ সোশ্যাল ডিস্টেনসিং বজায় রাখতে চায়, ব্যাটসম্যানদের আউট করে 'নমস্কার' করতে চায়, সেটা সে করতেই পারে।
প্রশ্ন) এবারের অস্ট্রেলিয়া সিরিজ স্টিভ স্মিথ-ডেভিড ওয়ার্নার আছেন। এরমধ্যে আবার বিদেশে প্রথমবার পিঙ্ক বল টেস্ট খেলবেন। কতটা চ্যালেঞ্জিং হতে চলেছে?
মহম্মদ সামি) স্টিভ স্মিথ-ডেভিড ওয়ার্নারের বিরুদ্ধে এর আগেও আমরা খেলেছি। এবং আগেও ওদের বিরুদ্ধে সাফল্য পেয়েছি। মানলাম ওরা বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান। কিন্তু দুজন ব্যাটসম্যান চলে আসা মানেই যে আমাদের সামনে বিশাল বড় বিপদ চলে এল এমনটা ভেবে নেওয়া উচিত নয়। একটা কথা মনে রাখা উচিত ক্রিকেট কিন্তু 'এক বলের খেলা'। ওরা খালি হাতেও ফিরতে পারে। আবার শতরানও করতে পারে। কারণ, ক্রিকেটে যে লাক অনেক বড় ফ্যাক্টর। আর পিঙ্ক বল টেস্ট ম্যাচের কথা যদি বলেন তাহলে বলব, আমি কিন্তু এই ম্যাচটা খেলার জন্য মুখিয়ে আছি। মোহনবাগানের হয়ে ক্লাব ম্যাচ, কিংবা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পিঙ্ক বল টেস্টের চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওদের ঘরের মাঠে গোলাপী বলে খেলার মজাই আলাদা। দুটি সমান শক্তিশালী দলের সামনাসামনি টক্কর হবে। এটা যেমন দু'দলের ক্রিকেটারদের কাছে উত্তেজনার ব্যাপার, তেমনই গ্যালারি ভর্তি দর্শকরাও এই ম্যাচের তাপ নেওয়ার জন্য অবশ্যই মুখিয়ে থাকবেন। এরমধ্যে আবার গতবার আমরা টেস্ট সিরিজ জিতেছি। তাই আগামী সিরিজে আরও টেনশন তৈরি হবে। সেটা এখন থেকেই টের পাচ্ছি।
প্রশ্ন) করোনা ভাইরাসের সময় আপনি পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য করছেন। এই বিষয়ে কিছু বলুন।
মহম্মদ সামি) এটা নিয়ে বেশি বড় করে কিছু বলার নেই। গরিব-দুঃস্থ মানুষদের প্রয়োজনে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ছোটবেলা পরিবার থেকে এই শিক্ষা পেয়েছিলাম। সেটাই এখন কাজে লাগাচ্ছি। আসল কথা হল আপনার মন যদি পরিস্কার হয়, আপনার যদি সমাজের জন্য কিছু করার ইচ্ছে থাকে তাহলে সবকিছু সম্ভব। আমি যা রোজগার করি তাতে অনায়াসে গরিব মানুষদের সেবা করতে পারি। সেটাই মন থেকে করছি। সেলিব্রেটি কিংবা 'রোল মডেল' হিসেবে এটা আমার কর্তব্য। এবং দেশের বাকি সেলিব্রেটিদের কাছে আমার আবেদন এই কঠিন সময় কষ্টে থাকা মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ান। আমার গ্রামের বাড়ির সামনেই রয়েছে ন্যাশনাল হাইওয়ে ২৪। সেখানে আমাদের উদ্যোগে 'ভান্ডারা' চলছে। রোজ প্রায় ৩৫-৪০ হাজার লোকজন এসে খাবার খাচ্ছেন। তাছাড়া সেই রুটের উপর দিয়ে যাওয়া বাস যাত্রীদের জন্য জল, কেক, বিস্কুট, ফলের ব্যবস্থাও আমরা করেছি। এভাবেই ওদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন) আমফানের জন্য আপনার কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আপনি কি এভাবেই পাশে দাঁড়াবেন?
মহম্মদ সামি) অবশ্যই সাহায্য করব। কোনও সংস্থা যদি আমার কাছে সাহায্য চায়, তাহলে আমফান দুর্গতদের পাশে অবশ্যই দাঁড়াব। এবং মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ কিংবা উত্তরপ্রদেশে সীমাবদ্ধ থাকব না। প্রয়োজন হলে বিদেশে এমন কোনও বিপর্যয় নেমে এলে সেখানেও আর্থিক সাহায্য করতে আমি রাজি।
প্রশ্ন) আপনাদের পেস বোলিং বিভাগের সাফল্যের রসায়ন কি?
মহম্মদ সামি) আমরা সবাই দেশের জন্য খেলি। এবং সেটাই আমাদের সাফল্যের প্রথম মন্ত্র। তাছাড়া আমরা একে অপরের সাফল্যে ঈর্ষা করি না। বরং আমরা একে অপরের জন্য খেলি। এটাই আমাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি আমাদের পেস বিভাগের রিজার্ভ বেঞ্চও বেশ শক্তিশালী। কোনও বিদেশ সফর হলেই তরুণ পেসারদের নিয়ে যাওয়া হয়। ওরাও সুযোগ পেলে ভাল পারফরম্যান্স করছে। তাছাড়া সবাই ফিটনেস নিয়ে খুব সচেতন। তাই আমাদের পেস বোলিংয়ের ভবিষ্যত নিয়ে আমি আশাবাদী।
প্রশ্ন) মহেন্দ্র সিং ধোনি ও বিরাট কোহলি দুজনের অধিনায়কত্বে খেলেছেন। দুজনের গুণ নিয়ে কিছু বলুন।
মহম্মদ সামি) দেশে ও বিদেশে সাফল্য পেতে গেলে দলের সঠিক ব্যালান্স খুব জরুরি। আর এই দলকে সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন স্মার্ট নেতার দরকার। আমাদের সৌভাগ্য যে দল মাহি ভাইয়ের পর বিরাট'কে অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছে। ওরা দুজনেই প্রচন্ড স্মার্ট। দুজনেই জিততে চায়। দুজনেই সতীর্থদের কাছ থেকে সেরা বের করতে পারে। তবে ওদের মধ্যে একটা জায়গায় বিস্তর ফারাক। মাহি ভাই ঠান্ডা মাথায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। ওনার কথা বলার স্টাইল একদম আলাদা। সেখানে কিন্তু বিরাট প্রচন্ড আক্রমণাত্মক।
প্রশ্ন) জাতীয় দলে প্রচুর সাফল্য পেলেও আইপিএলে তেমন নজর কাড়তে পারেননি। এটা নিয়ে কিছু বলবেন?
মহম্মদ সামি) গত মরসুমে কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের হয়ে ১২ ম্যাচে ১৯ উইকেট নিয়েছি। ভারতীয় বোলারদের মধ্যে আমার সেরা পারফরম্যান্স ছিল। তাই আমার মনে আগের ফ্রাঞ্চাইজিগুলো এভাবে পাশে থাকলে আইপিএলের মঞ্চে আরও ভাল পারফরম্যান্স করতে পারতাম।
প্রশ্ন) শোনা যাচ্ছে দুবাইতে আইপিএল আয়োজিত হবে। এই বছর কি ক্রোড়পতি লিগ আদৌ আয়োজন করা সম্ভব?
মহম্মদ সামি) দেশজুড়ে যেভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে তাতে কি হবে এখনই বলা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে সেটা এখনই জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তাই দেশের বাইরে আইপিএল আয়োজিত হবে
না ফাঁকা স্টেডিয়ামে খেলা হবে, সেগুলো তো বিসিসিআই ঠিক করবে। অবশ্য সবার আগে কেন্দ্র সরকারের গ্রীন সিগন্যাল পাওয়াও তো জরুরি।
প্রশ্ন) শেষ প্রশ্ন। ছোট্ট মেয়ে আইরা'র জন্য মন কতটা কাঁদে?
মহম্মদ সামি) অবশ্যই মেয়ের জন্য মন কাঁদে। বাবা হিসেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। ওকে কোলে তোলার জন্য সবসময় ছটফট করি। প্রতি মুহূর্তে ওর কথা ভাবি। অনেক মাস আগে বেবো'র সাথে কথা হয়েছিল। তারপর আর কথা হয়নি। গত কয়েকমাসে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওরা মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেয় না। আমার ঝামেলা-অশান্তি একদম ভাল লাগে না। তাই তো মন খারাপ হলেই ছবি আঁকতে বসে যাই। বেবো'র জন্য ছবিও এঁকেছি। এবং আল্লা যদি মুখ তুলে তাকান তাহলে একদিন ওকে আমার কাছেও নিয়ে আসব। ওকে কোলে নিয়ে ঘুরে গোটা গ্রাম ঘুরে বেড়াবো। কথা দিলাম।