সত্যিই দু'নৌকায় পা? ভেবে বলছেন তো?

অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় : সেবার সৌরভের বাড়িতে আমির খান এসেছেন। বসার ঘরের সমস্ত স্মারক, ছবি সবটা ঘুরে দেখাচ্ছেন সৌরভ। নাগপুরে সহ খেলোয়াড়দের কাঁধে সৌরভের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের মুহুর্ত দেখে বললেন, "তুমি কিন্তু আরও কিছুদিন খেলতে পারতে দাদা। বড্ড তাড়াতাড়ি অবসর হয়ে গেল তোমার।" সৌরভ হাসছিলেন, "আমি যেদিন বেঙ্গালুরুতে প্রেস কনফারেন্সের আগে ড্রেসিংরুমে গিয়ে টিমকে বললাম যে আমি অবসর নিচ্ছি, শচীন মানতে পারেনি। বলেছিল, দাদি কেন? এখন সবচেয়ে ভাল ক্রিকেটটা তুই খেলছিস, কেন ছেড়ে দিবি? আমি বলেছিলাম, তোরা বুঝবি না, আমাকে কী কী সহ্য করে ক্রিকেটটা খেলতে হয়।" সহ্য তাঁকেই বারবার করতে হয়, কিন্তু কেন? কেন তাঁকেই বারবার আক্রান্ত হতে হয়? কেন তাঁকেই বারবার রিং-এ কোনঠাসা করে অনবরত হুক, জ্যাব, পাঞ্চে গোটা শরীর রক্তাক্ত করা হয়? আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ, সৌরভ সবসময় এক নম্বর হওয়ার স্পর্ধা দেখান। যাঁরাই দেখিয়েছেন তাদেরকেই সহ্য করতে হয়েছে। ত্রিপুরি কংগ্রেসের পর সুভাষ চন্দ্র বসুকে যা সহ্য করতে হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীত্বের ক্ষেত্রে পলিটব্যুরোয় জ্যোতি বসুকে যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সৌরভকেও তাই সহ্য করতে হয়! আসলে এদেশের এখনও অনেকেই ভাবে, বাঙালি মানে দুই নম্বরে থাকবে। দেশজুড়ে প্রচুর শ্রদ্ধা পাবে, ক্রিয়েটিভিটির জন্য আকুন্ঠ সাধুবাদ পাবে, শিল্প-সাহিত্যে অবদানের জন্য গালভরা প্রশংসা পাবে, ভাল সিইও হবে, কোম্পানি একা হাতে চালাবে, কিন্তু কোম্পানিটা তোমার হবে না! তুমি উপপ্রধানমন্ত্রী অবধি পৌঁছাবে বড় জোর, প্রধানমন্ত্রী হবে না! দেবীলাল হতে পারেন, গুজরাল হতে পারেন, নরেন্দ্র মোদি হতে পারে, কিন্তু কোনও জ্যোতি বসু, প্রনব মুখার্জি কিংবা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সে শিকে ছিঁড়বে না কোনওদিন।
সৌরভের সঙ্গে সমস্যার বড় জায়গাটা তাঁর ব্যক্তিগত জ্ঞান, ক্রিকেট প্রজ্ঞা, সিদ্ধান্ত নেওয়া আর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। যেটা বিশ্বাস করেন, সেটার জন্য লড়ে যান। এই স্পর্ধাটা মানা যে অনেকের পক্ষেই খুব কঠিন। এই যে রজার বিনি ক্ষমতায় আসছেন, দেখবেন তাঁর সঙ্গে কোনও সমস্যাই নেই। তিনি কোনও একজন 'রাহুল দ্রাবিড়'কে কোচ করে আনার জন্য মরিয়া হবে না, ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি বাড়ানোর জন্য জেদ করবেন না, টিম সিলেকশন নিয়ে নিজের মতামত সরাসরি জানাতে কুন্ঠিত হবে, কোনও বেয়াড়া ক্রিকেটারের মিথ্যার বেসাতিকে সামনে আনার সাহস পাবেন না, 'পিঙ্ক বল' টেস্ট বা সেরকম কিছু নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের বদলে বেঙ্গালুরুতে আনার জন্য বায়না করবেন না, জেন্টলম্যান বিনির তাই কোনও সমস্যা হবে না! সৌরভের মতো নয়, রীতিমতো বিদায় সম্বর্ধনা পাবেন তিন বছর মেয়াদ শেষ হলে। আবার নতুন কেউ আসবেন। 'তাঁদের' ইচ্ছেমতো কেউ। আসলে 'তাঁরা'ই নেপথ্যে সবটা। 'তাঁরা' যেমন চাইবেন, তেমন হবে। কখনও সৌরভ হবেন, কখনও বিনি হবেন, কখনও অন্য কেউ হবেন, কিন্তু আসলে থাকবেন 'তাঁরা'। গুজরাট থেকে রিমোট কন্ট্রোলে নিয়ন্ত্রিত হবে সবটা। সৌরভের ক্ষেত্রে হিসেবটা একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। সৌরভ যে বশ্যতা স্বীকারের মানুষ নয়, রাজনৈতিক বকলেসটা গলায় দেবার লোক নন, সেটা বুঝতে পারেননি অমিত শাহ, জয় শাহরা। তাই যে ভাবনা থেকে সৌরভকে সভাপতিত্ব উপহারের পরিকল্পনা, সেটা আদৌ কাজে আসেনি। তিন বছর আগে সৌরভকে সভাপতি ঘোষণার দিনও তাঁকে বলা হয়েছিল, বাংলার আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির মুখ হতে হবে। প্রস্তাববাহক অনুরাগ ঠাকুরকে সৌরভের উত্তর ছিল 'এটা কখনই বিনিময় মূল্যে নির্ধারিত হতে পারে না।' তবু বিজেপি আগে তাদের হাতটা বাড়িয়েছিল, ধরেননি সৌরভ, তাই কেন সৌরভকে সহ্য করবেন তাঁরা! যা দেখলেন, তাতে অবাক হওয়ার কিচ্ছু ছিল না! বরং সবটাই বড্ড প্রত্যাশিত। আইপিএল কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের পোস্ট ছুঁড়ে দিয়ে আনুগত্য কেনার বৃথা চেষ্টা হয়েছিল, বাংলার ছেলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসে প্রমাণ করেছেন, বাঙালির মেরুদন্ডটার এখনও সবটা বিক্রি হয়ে যায়নি। বেচারার কপালটা বোধহয় খারাপ। এমন একটা রাজ্য প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি, যেখানে তাঁর মতো সফল, স্বচ্ছ, মার্জিত অথচ লড়াকু মুখ নেই। বঙ্গীয় রাজনীতির মুখ এখন কারা, কারা বাঙালি জাতির সব ভাবনা, চিন্তা, চলচ্চিত্র, সাহিত্য, শিক্ষা, অর্থনীতি সবটার ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট নিয়ে বসে আছেন সবটা তো আমাদের সবার জানা। তাই তাঁদের মাঝে সৌরভকে দেখামাত্রই জিভ লকলক করছে এক দলের, 'যেভাবে হোক এই বাঙালির পানসি ভেড়াও আমাদের ঘাটে।'
কিন্তু কেন? কেন একজন সফল মানুষকে রাজনৈতিক পরিচয়েই শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে? সৌরভ গাঙ্গুলির ১০০টা টেস্ট, ৩০০টা ওয়ান ডে, টিম ইন্ডিয়া তৈরির যে সোনালি মার্কশিট, সবটা ভ্যানিশ হয়ে গিয়ে শুধুই আলোচনা হবে, তিনি কতটা মমতা ঘনিষ্ঠ, কতটা অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ, কীভাবে দু'নৌকোয় পা দিয়ে চলেন, আরও কত কিছু! কিন্তু দু'পক্ষের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক, সৌহার্দ্য থাকলে সমস্যাটাই বা কী! বরং সেটাই তো কাম্য। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যে রাজ্যের একজন সফল মানুষের সৌহার্দ্য থাকবে সেটাই তো প্রত্যাশিত। ভারতের সবচেয়ে অধিনায়ক, দেশের একজন কিংবদন্তী ক্রিকেট ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুসম্পর্ক থাকবে, সেটাই তো কাম্য। খেলোয়াড়দের জীবনে তো তাই হয়ে এসেছে। বুদ্ধবাবুর মঞ্চে সংবর্ধনা নিয়ে অটলবিহারি বাজপেয়ির শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে পাকিস্তানে যাবার ফ্লাইটে উঠতে হয়েছে সৌরভকেই। এটা দু'নৌকোয় পা? ভেবে বলছেন? সৌরভ গাঙ্গুলি কি ২১ জুলাইয়ের সভায় গিয়ে ঘাসফুলের পতাকা উড়িয়েছেন, নাকি আমেদাবাদে অমিত শাহের মঞ্চে পৌঁছে পদ্মফুল ফোটাচ্ছেন? ঠিক কোনটা করলেন বলতে পারেন? বরং বাঙালির আরও একবার গর্ববোধ হওয়া উচিত ছিল, রাজনৈতিক ক্ষমতার এত প্রলোভন সত্ত্বেও এক বাঙালি নিজের শিরদাঁড়াটা সোজা রেখেছেন, বিক্রি করে দেননি। অথচ দেখুন সবাই দাঁত নখ বার করে এলেন। বর্ষীয়ান এক সাংবাদিক থেকে চুড়ান্ত অসৎ সিএবি কর্তা (টিকিট থেকে জলের পাউচ কত কী বলব), যিনি সৌরভের 'বাপি বাড়ি যা' শটে ইডেনচ্যুত হয়ে আপাতত কলকাতা পুরসভার অফিসে আশ্রয় নিয়েছেন, সবাই সুযোগ বুঝে সার্চলাইট হাতে বেরিয়ে পড়লেন। এই প্রাক্তন সিএবি কর্তা ফেসবুকে লম্বা চওড়া ভাষণ দিলেন। তাঁর বিরাট ক্ষোভ, সৌরভকে কেন মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি সিএবি সভাপতির চেয়ারে বসিয়েছিলেন। জগমোহন ডালমিয়ার মৃত্যুর পর অশৌচ অবস্থায় অভিষেক ডালমিয়াকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। একা নয়, বিশ্বরূপ দেও ছিলেন সঙ্গে। সিএবি-র সচিব তখন সৌরভ, বিশ্বরূপ কোষাধ্যক্ষ। একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতি, একটা হঠাৎ তৈরি হওয়া 'ক্রাইসিস' ম্যানেজমেন্টের জন্য সিএবি-র কর্তারা জগমোহন ডালমিয়ার উত্তরসূরিকে নিয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। বিশ্বরূপের নিশ্চয়ই এই 'নবান্ন অভিযান'-এ সায় ছিল, নইলে গেলেন কেন? সেখানে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, সভাপতি হবে সৌরভ! কী আশা করেছিলেন, বিশ্বরূপের নাম ঘোষণা করবেন? মেনে নিলাম, চুড়ান্ত অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি। কিন্তু সেটা তো সৌরভ গাঙ্গুলি করেননি। নিশ্চয়ই নবান্নের ১৪ তলায় গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে আবদার করেননি, 'দিদি আমায় প্লিজ সিএবি প্রেসিডেন্ট করে দিন।' তাহলে করলেন কে? বিশ্বরূপের বর্তমান নেত্রী। কিছুদিন গোঁসা টোসা করে বিশ্বরূপ দে আশ্রয় নিলেন দিদির ক্যাম্পেই। কী দ্বিচারিতা, সত্যি। সাহস থাকলে তখনই তো নির্বাচন করতে পারতেন। পারেননি? ঠিক আছে, তাহলে এখন করুন, দেখিয়ে দিন, 'কিসমে কিতনা হ্যায় দম।'
নিশ্চিত থাকুন, বিশ্বরূপ আবার পালাবেন। পুরনো একটা সংবাদপত্রর রিপোর্টে নবান্ন থেকে ফিরে সৌরভের বক্তব্য পড়ছিলাম। 'সবে তিনদিন। মিস্টার ডালমিয়া মারা গেছেন সবে তিনদিন হয়েছে। এখন এসব নিয়ে আলোচনাই করতে চাই না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন। কিন্তু আমি প্রেসিডেন্ট হতে তখনই রাজি, যখন সিএবি-র ১৩৩টি সদস্যই আমাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাইবে!' যতদূর মনে পড়ছে ডালমিয়ার অবর্তমানে সিএবি-র প্রতিটি সদস্য তৎকালীন সচিব সৌরভ গাঙ্গুলিকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিল। অগণতান্ত্রিক হল? কেন তখন বিরোধিতা করেননি বিশ্বরূপ? এখন কি লাভ 'বিষ' ছড়িয়ে!
রজার বিনিও বোর্ড সভাপতি হবেন অমিত শাহর বদন্যতায়। তাঁর রাজ্যের কেউ বলবে না, অমিত শাহর সঙ্গে সেটিং করে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হলেন বিনি। কিন্তু সৌরভের পিছনে আদা জল খেয়ে লেগে যাবেন কিছু 'হিংসুটে' বাঙালি। অথচ ওটাই দস্তুর। ওটাই নিয়ম। ভারতের খেলাধূলায় শীর্ষপদে থাকতে গেলে বিজেপি-র বদান্যতা চাই। কল্যাণ চৌবের চাই, দিলীপ তিরকের চাই - সবার চাই। অবশ্য দেশে আর আলাদা করে কী বলব! রাজ্যেও তো সেই একই ছবি। আইদার মাই ওয়ে; ওর গেট লস্ট ফ্রম দ্য হাইওয়ে। তাই সমালোচনা করতে হলে এই সিস্টেমটার করুন। যে লোকগুলো এই আতঙ্কের আবহটা তৈরি করেছেন, তাঁদের করুন। যাঁরা 'ভিকটিম', তাঁদের করে কী লাভ। কী লাভ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে। বরং গর্ববোধ করুন সেই বাংলার ছেলের জন্য যে মুখের ওপর বলে আসতে পারেন, না। সৌরভ জীবনের সবকিছু আবার মসৃণ মাখনের মতো হয়ে যেত, যদি একবার অমিত শাহকে 'হ্যাঁ' বলতেন। কিন্তু সবাই তো আপোষটা করতে পারেন না। যেদিন মুম্বইয়ের মিটিং সেরে ফিরলেন, রাতে কথা হচ্ছিল ওঁর বাড়িতে। সৌরভ ঘনিষ্ঠ একজন বলছিলেন, 'হ্যাঁ বলেই দিতে পারতে দাদা।' হঠাৎই টানটান হয়ে গেল শরীর, চোখে বিদ্যুতের চমক। "আমি ভিখারি নাকি! সেদিনও বলেছিলাম, কোনও কিছুর শর্তে আমি প্রেসিডেন্ট হব না, আজও তাই বলছি।"
এই মানুষটার জন্য গর্বিত হবেন না? এই মানুষটার পাশে থাকবেন না? এই মানুষটার জন্য কলম ধরবেন না? দাদাগিরি-র যে গানটা অরিজিৎ সিং গেয়েছিল, তার লিরিক্স রাত জেগে লিখেছিলাম আমি আর অরিজিৎ। আমি লিখলাম, ল্যাটা ব্যাট বল শাসন, লড়কে লেঙ্গে চাল চলন। গানের মিটারের সুবিধার্থেই অরিজিৎই যোগ করেছিল লাইনটা, 'শালা লড়ে পারবে না।' ১৪ বছর কেটে গেছে ওই রাতটার। কিন্তু এখনও যেন মনে হয়, ওটাই যেন ঠিক লাইন সৌরভ গাঙ্গুলির জন্য। 'শালা লড়ে পারবে না।' যে কেউ চেষ্টা করে দেখতে পারেন!