বাঙালি ফুটবলারদের ভবিষ্যৎ কী? | পর্ব - ২

সাইফ: আমি তখন ক্লাস নাইন, সবে ক্লাস শুরু হয়েছ। তখন ম্যাকডাওয়েল কাপ হত ঠিক কলকাতা লিগ শুরুর আগে। আমাদের এলাকার খেলাধূলার সংস্কৃতিতে ঘটে গেল এক যুগান্তকারী ঘটনা। আলি রেজা সেবার মোহনবাগানে, আমরা ডাকতাম মিলুদা নামে। ইস্ট- মোহন বড়ো ম্যাচে দূরপাল্লার শটে গোল ছিল আমাদের মিলুদার। পরদিন সব কাগজের হেডলাইন হয়েছিল আলি রেজার জয়ের লাফ।
এই ঘটনা আমাদের কিশোর আর যুবক মনে উদ্দীপনা এনে দিয়েছিল। বিকেলে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে আমাদের 'সেভেন এ সাইড' স্কুল মাঠটার দিকে যেত আমাদের সুপারস্টার, সঙ্গে থাকত বিশ তিরিশ জন কিশোর। আমিও সামিল হতাম। তাঁর কঠোর অনুশীলন, নিয়মানুবর্তিতা সবকিছু আমাদের প্রেরণা যোগাত। অফটাইমে গান শোনা, মনোযোগ বাড়াতে মাছধরা; তাঁর সব কিছুই ছিল অনুকরণ-যোগ্য। ফুটবলের তারকারা আমাদের লাইটহাউস ছিল। এটাই ছিল আমাদের এবং আমাদের আগের প্রজন্ম গুলির ইতিহাস।
আজও আমাদের স্কুল মাঠটা আছে, সকালে অনেক বাচ্চারা অনুশীলন করে।দায়িত্ব নিয়ে প্র্যাক্টিস করাচ্ছেন আর এক প্রাক্তন ফরিদ আলি মোল্ল্যা।আজকালের ছেলেরা কেউ বেইতিয়া হতে চায়, কেউ রয় কৃষ্ণা হতে চায়। অথচ কেউ আলি রেজা হতে চায় না আর। কেনই বা হবে? গ্রাম বাংলা বা মফঃস্বলের ফুটবল হাব গুলোতে আর কোনও সুপারস্টার নেই। আসলে আজকালকার কিশোরদের সামনে আর কোনও প্রেরণাই নেই।
বাংলার ছেলেরা বাংলার দল গুলিতে স্ট্রাইকার, সেন্ট্রাল মিডফিল্ড বা স্টপারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পজিশন পায় না। এখানে ভিড় বিদেশিদের। বাকি যে জায়গা গুলি আছে সেগুলি ভিন রাজ্যের ফুটবলারদের দখলে। এই অবস্থায় সত্যি সঙ্গীন আমাদের ফুটবলারদের অবস্থা।
ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান বা জাতীয় দলের কথা বাদ দিন। অনেক ফুটবলার বড় দলে খেলেননি, কিন্তু একটা সময় তাঁরা বাংলার আঞ্চলিক সুপারস্টার ছিলেন। কলকাতায় ছোট দলে নিয়মিত খেলেছেন আর ফুটবল খেলে চাকরি পেয়েছেন। ফুটবল খেলে চাকরি, এই কনসেপ্টটা বাংলার গ্রাম, মফঃস্বল থেকে প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। সাধারণ দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ফুটবল খেলে রেল, ইনকাম ট্যাক্স, পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি করেছেন। নিজের কাঁধে করে সংসার টেনেছেন সঙ্গে এলাকার ছেলেদের কাছে উদাহরণ হয়েছেন, ফুটবল খেলেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়।
আজ কর্মক্ষেত্র ছোট হয়েছে, চাকরিও কমেছে। ফলে ফুটবলাররা ফুটবল খেলে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কম। এক সময় এলাকাতে যাঁদের খেলা দেখে চমকে উঠেছি, যাঁদের অদম্য লড়াই আর জন্মগত স্কিল দেখে গুরু মনে করতাম, আজ তাঁদের কাউকে দেখি চালের মিলে বাহক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে কোনওমতে দিন যাপন করেন, কেউ সস্তা শ্রমিক হিসেবে চালাচ্ছেন নিজের জীবন। গরীব বাড়ির ছেলেটা স্বপ্ন দেখত ফুটবল খেলে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। ঘর-ভর্তি ট্রফি, মেডেলের ভিড় থেকে খুশি সরে গেছে। বাড়ির হাল ফেরেনি। একসময় যে সব চোখ গুলি এই মানুষদের দেখে অনুসরণ করত, সেই সব চোখ গুলি ধূসর হয়েছে । আসলে নিভে গেছে গ্রাম মফঃস্বলের সবকটি লাইট হাউস। ফুটবল খেলে আর বাঙালি প্রতিষ্ঠিত হয় না।
এসময়ের নতুন প্রজন্মের আর মাঠ মুখো না হতে চাওয়ার এটা একটা বড় কারণ!
চলবে…