সংস্কৃতির বিসর্জন ও বাঙালি ফুটবলারদের ভবিষ্যৎ কী? | শেষ পর্ব

সাইফ: ডিস্ট্রিক্ট লিগগুলো বন্ধ তাও প্রায় অনেক দিন হতে চলল। যেগুলো হয় একেবারে নমো নমো করে হয়। আগে যখন জেলা লিগ হত তার মান ছিল অনেকটা কলকাতা লিগের মত। কলকাতা লিগে সুপার ডিভিশন বা ফার্স্ট ডিভিশন খেলা ফুটবলাররা নিজের ডিস্ট্রিক্টের হয়ে খেলতেন। ফুটবলের মান তখন ছিল গগনচুম্বী। মাঠে দর্শক হতো দেখার মত।
এর দায় কার? আইএফএ? জেলা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন গুলি না অন্য কিছু?
আসল দায় মার্কেট ইকোনমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই নব্য সভ্যতার। একটা শ্রেণির মানুষ ভাবছেন ফুটবল থেকে কিছু মিলবে না। সেই শ্রেণির মানুষই ভাবছেন থিয়েটার থেকে মিলবে না, মিলবে না লিটল ম্যাগাজিন থেকে কোনও কিছু। জীবনের লাভ-ক্ষতির হিসেব হচ্ছে অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ওপর। চর্চা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত যে বাঙালি জাতি সেই বাঙালি জাতির মেরুদন্ডের অবক্ষয় ঘটেছে, তা প্রায় অনেকদিন হল।
পাড়ায় পাড়ায় অনেক ফুটবল মাঠ ছিল, সকালে বিকেলে খেলার আয়োজন হত। আমাদের পাড়ায় যে ফুটবল মাঠ আছে, সেখানে কলকাতা লিগে সুপার ডিভিশন, ফার্স্ট ডিভিশন খেলা এলাকার ফুটবলাররা বিকেলে ফুটবল খেলতে নামত। খেলা হতো দু'দলে ভাগ করে। তারা ছিলেন আমাদের চোখে ছোটবেলার হিরো। কেউ বড় ক্লাবে খেলতেন, কেউ পরিচিত কোনও ক্লাবে। খবরের কাগজে কোনও কোনও ফুটবলারের নাম পেতাম। আরও বেশি সংখ্যক ফুটবলার বুট পরে মাঠের বাইরে বসে থাকতেন, খেলার সুযোগ পেতেন না। এলাকার একশ্রেণির ফুটবল-ভক্ত মানুষ রোজ বিকেল সাড়ে তিনটে-চারটে বাজলে মাঠের ধারে চলে যেতেন । দু'শ-আড়াইশো মানুষ রোজ এই প্র্যাকটিস ম্যাচ দেখতে আসতেন। এই ম্যাচগুলি কখনও কখনও ভয়ঙ্কর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচ হয়ে উঠত। আমাদের তারকা ফুটবলাররা এভাবেই মনোরঞ্জন করতেন। নতুন ফুটবলারও সুযোগ পেত। সব মিলিয়ে এলাকাতেই চলত পরবর্তী পরম্পরা তৈরির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।এই ঐতিহ্য আজ ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।
এছাড়া ছিল ফুটবল-হাব কনসেপ্ট। ধরুন শ্যামনগর, খরদা, বেলঘড়িয়া, কতগুলি জাতীয় ফুটবলার জন্ম দিয়েছে এই হাবগুলির কথা একবার ভাবুন। এছাড়া হাওড়া-হুগলি লাইনে চুঁচুড়া-ব্যান্ডেল, চন্দননগর এরকম আলাদা আলাদা করে ফুটবল-হাব ছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারুইপুর, ক্যানিং, বজবজেও এরকম করে ছোট ছোট হাব ছিল। অথচ এখন এই সবগুলি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ভোরবেলা পাঁচটা আটান্নর ট্রেন ধরে ছেলেরা একটা ছোট কিট ব্যাগ নিয়ে ময়দানমুখি হত। আজও পাঁচটা আটান্নর ট্রেন যায়, কিন্তু ফুটবল মাঠে ছেলেদের অভাব ঘটে গেছে সাংঘাতিকভাবে। আসলে সংস্কৃতির পতন ঘটেছে বাঙালি জাতির। যদি বাঙালি সাংস্কৃতিকভাবে নিজেদেরকে বলিয়ান ভাবে, তাহলে সাহিত্য- থিয়েটারের সঙ্গে ফুটবলও সমানভাবে সম্পৃক্ত ছিল। চর্চার অভাবে, আজ সমস্ত সংস্কৃতির সঙ্গে ফুটবল সংস্কৃতিরও জলাঞ্জলি ঘটতে চলেছে।
শেষতম যে কারণটি: এখন যদি ময়দানে চোখ রাখেন, দেখবেন আদিবাসী বাঙালি ফুটবলাররা ভিড় করছে ময়দানে অথবা বলা ভাল কিছুটা সংখ্যায় বেশি। এর পাশে সংখ্যালঘু মুসলিম শ্রেণি রয়েছে, যাদের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের ফুটবল। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবার থেকে ফুটবলার আসছে বাংলার ময়দানে অথচ একসময় বাংলার ফুটবলে প্রশান্ত ব্যানার্জি, সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যদের মত মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বাংলার ময়দানে ফুটবলার এসেছে। আজ মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ফুটবলার আসছে না। যে সমস্ত বাবা-মায়েরা আগে তাদের কোন একজন সন্তানকে ফুটবলে দিতেন অথবা বিরাগভাজন হয়েও ফুটবল খেলছে ছেলে, জেনে মনে মনে তৃপ্ত হতেন। আজ সেই সব বাবা-মায়ের ভয়ঙ্কর অনুপস্থিতি বাংলার ঘরে ঘরে। যেটুকু আছে পুরোটাই ক্রিকেটের জন্য নিমজ্জিত। ফুটবল বডি-কন্টাক্ট গেম, বাবা-মায়েরা চাইছে না ফুটবল খেলে তাঁদের সন্তান চোট পাক। সবমিলিয়ে ফুটবল থেকে ক্রমশ বিমুখ হচ্ছে বাংলার বাবা-মায়েরা। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত বাড়ি থেকে সন্তানেরা যদি ফুটবল খেলতে না আসে তাহলে অনেকগুলি সমস্যা দেখা দেয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেরা সঠিক পুষ্টি এবং সঠিক শিক্ষার অভাবে বেশিদূর পৌঁছতে পারে না। ফুটবলে পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং আধুনিক শিক্ষা পারস্পরিক ভাবে সম্পর্কযুক্ত। বিদেশি কোচ আসছেন। যদিও ফুটবলের নিজস্ব ভাষা আছে কিন্তু আধুনিক ফুটবলের অনেক কিছু জানতে হলে প্রাথমিক শিক্ষাটুকু দরকার পড়ে। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা ফুটবলাররা পারিবারিকভাবে অনেকটাই এগিয়ে থাকত। এখন যার অভাব সুস্পষ্ট, আর ঠিক এই জায়গাতেই ভয়ঙ্কর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে আমাদের ফুটবল।