খেপেই মুক্তি। বাঙালি ফুটবলারদের ভবিষ্যত কী? পর্ব - ৩

সাইফ: বাবলু, মনোরঞ্জন, মানস, বিদেশ, প্রসূন। বাঙালি ফুটবল থেকে এই নামগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে। দীপেন্দু, নবি, মেহতাব এই নামগুলিও অতীত। তার বদলে এসেছে বিদেশি এবং ভিন রাজ্যের অসংখ্য ফুটবল তারকা। একজন বাঙালি উঠতি ফুটবলার বা একজন সাধারণ বাঙালি ফুটবলভক্ত মানুষ যেভাবে বঙ্গসন্তান ফুটবলারদের সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারেন, সেভাবে পারেন না বিদেশি তারকাদের সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে। এর মধ্যে থেকেও নয়নের মণি হয়েছেন। মজিদ, চিমা, ব্যারেটো, বাইচুং, সুনীল ছেত্রীরা। বক্তব্য হল, যেভাবে সত্তর এবং আশির দশকে বাঙালি তাঁর নিজের তারকাকে খুঁজে পেতেন নিজের পাড়ায় বা পাশের পাড়ায়, সেরকমভাবে আর তারকাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। গত দুটি পর্বে আমি নানান ভাবে বলার চেষ্টা করেছি, জাতীয় স্তরে বাঙালি ফুটবলারদের অভাবের কারণ কী!
বাঙালি ফুটবল প্রতিভা শ্বাস নিতে ছোটে কলকাতা লিগের নিচের দিকের দলগুলিতে। কেউ মাসিক চুক্তিতে, কারোর সঙ্গে লিগ চলাকালীন চুক্তি বা ম্যাচ পিছু, অনেকেই আবার যাতায়াতের টাকাতেই সন্তুষ্ট থাকেন। চুক্তির পরিমাণ এতটাই কম, যে কোনওভাবে সংসার নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরে বারুইপুর, ইছাপুর, শ্যামনগর বা চন্দননগর, ব্যান্ডেল থেকে যে ছেলে ভিড় ঠেলে কলকাতা ময়দানে আসত, সঙ্গে থাকত একটা কিট ব্যাগ। সকালে খালি পেটে তিন ঘণ্টা প্র্যাক্টিসের পর ক্লাব ক্যান্টিনে ভরপেট ভাতটাই যার প্রোটিন, ভিটামিন ছিল। তার চোখে স্বপ্ন ছিল, আগামির। অচলায়তন ভেঙে দিয়ে পরিবার এবং পারিপার্শ্বিকতাকে টেনে তোলার অদম্য ইচ্ছে ছিল তার। অথচ আজ ট্রেন গুলিতে সেই ভিড় কমছে। আসলে স্বপ্নের রং ফিকে হচ্ছে রোজ।
বাঙালি ফুটবলাররা ঠিক কী করেন এখন? লিগের মরসুম শেষ হলে, পুজোর পর থেকে সারা শীতকাল এবং গরমের আগে পর্যন্ত বাংলা জুড়ে চলে খেপের ফুটবল। 'খেপ' শব্দটা প্রাতিষ্ঠানিক। যাঁরা খেপের ফুটবলের আয়োজক, তাঁরা এই নামকরণ করেননি। বড় ক্লাবের ফুটবলাররা খেপের মাঠে কেউ কেউ ফুটবল খেলতেন বা খেলেন। আমাদের ক্যামেরার সামনে ধরা পড়েছে বেশ কয়েকবার। অনেকে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য খেপের মাঠে ফুটবল খেলেন, অনেকে অনেক দাদা-বন্ধুদের আবদার মেটাতে খেপের মাঠে নামতে বাধ্য হন । কিন্তু সে সব এখন কমলেও পাড়া ফুটবলে জীবন নির্বাহ করছেন অসংখ্য বাংলার ফুটবল প্রতিভা, একথা সত্যি। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান-এর মত দলে সুযোগ না পেয়ে সংসার নির্বাহ করার জন্য এভাবেই ফুটবল জীবন অতিবাহিত করেছেন, করছেন অনেকেই, এমন উদাহরণ আছে ভুরিভুরি। তারকাদের নাম এখানে নিচ্ছি না তবে আমাদের জানা অনেক ফুটবলার আছেন, যাঁদের স্কিল এবং ফুটবল প্রতিভা দেখার জন্য মাঠে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শক ছুটে আসেন। এই সমস্ত ফুটবল টুর্নামেন্ট গুলিতে পুরস্কারমূল্য বেশ কয়েক লাখ পর্যন্ত। এই সমস্ত মাঠে যে দলগুলি খেলে, তারা একটি নির্দিষ্ট দল নয়। বরং, বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাল ফুটবলার নিয়ে এসে 'সেভেন এ সাইড' অথবা 'সিক্স এ সাইড' মাঠে পারদর্শী এবং সুনাম অর্জনকারী ফুটবলারদের নিয়ে দল গঠন হয়। এখানে সিন্ডিকেট চলে। সেট টিম বিভিন্ন মাঠে খেলে বেড়ায়। এক একজন ফুটবলার ঈর্ষণীয় পেমেন্ট পান। এখানেও এজেন্ট কনসেপ্ট আছে। অনেক প্রাক্তন ফুটবলার, যাঁরা এই খেপের মাঠে একসময় সুনাম অর্জন করেছিলেন তাঁরাও দল সাজিয়ে উপার্জন করেন বা যারা অর্থ ঢালেন তাদের হয়ে দল গঠন করে দিয়ে নিজেরাও অর্থ উপার্জন করেন।
ব্যবসায়ী অথবা ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দলের মালিক হন। একদিনের মালিক। সামান্য একদিনের ফুটবলে বেশ কয়েক লক্ষ টাকার দল সাজিয়ে টাকা উড়িয়ে দেন তাঁরা। সব জায়গায় যে তাঁরা চ্যাম্পিয়ন হবেন তা নয়। অনেক জায়গাতেই তাঁরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে যত টাকা উপার্জন করেন, তার চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে দেন ফুটবলারদের পিছনে। এইসমস্ত অর্থ প্রদানকারী মানুষদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে জেনেছি, তাঁরা কিন্তু কোনওভাবেই কলকাতা লিগের পিছিয়ে থাকা কোনও দলকে নিয়ে ভাল একটি ফুটবল দল গঠন করতে ইচ্ছুক নন। ফুটবলের মূলস্রোতে অর্থ দেওয়াকে তাঁরা অপচয় বলে মনে করেন। একদিনে তারা দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে পারেন। সারা বছর জুড়ে দশটি টুর্নামেন্টে এক কোটি টাকা খরচ করতে পারেন। কিন্তু সারা বছরের জন্য নির্দিষ্ট একটি দলকে বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে অর্থ প্রদান করে, মূলস্রোতের ফুটবলকে চালিত করার কোনওরকম প্রয়াস তাঁরা দেখাবেন না। এমনকী, যাঁরা এই সমস্ত প্রতিযোগিতার আয়োজক তারাও একটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা অথবা তারও বেশি অর্থ খরচ করেন। নানান সোর্স থেকে অর্থ সংগ্রহ করে একদিনের টুর্নামেন্টকে জাঁকজমক করার চেষ্টা করেন। তাঁদেরকেও আপনি যদি প্রস্তাব দেন, এই সম্মিলিত শক্তি দিয়ে কোনও একটি নির্দিষ্ট দলের দায়িত্ব নিতে, যে দল কলকাতা লিগের যে কোনও ডিভিশন থেকে ভাল পর্যায়ে উঠে আসতে পারে এবং জাতীয় স্তরেও পরবর্তীকালে ভাল খেলতে পারে, আপনার প্রস্তাবকে তাঁরা অত্যুক্তি ভাবতে পারেন, দিবাস্বপ্ন ও ভাবতে পারেন অথবা তারা ভাবতেই পারেন 'আমরা তো এই নিয়েই সুখী'। আসলে হয়ত সৎ পরামর্শ দেওয়ার এবং নেওয়ার অভাব রয়েছে ফুটবলের এই অপচয়ে। কে বোঝাবে এঁদের, পঞ্চাশ ষাট লাখ টাকায় আই লিগে দল নামাচ্ছেন অনেকে? বাংলার ফুটবলে এরকম কয়েকটি ইনভেস্টরকে এক টেবিলে বসালে একটি দল নেমে যেতে পারে নিঃসন্দেহে। এখন আপনি বলতেই পারেন, এটাও তো ফুটবল, মানুষ আসছেন, দেখছেন তবে অপচয় কেন হবে? উত্তর, যে দেশের ফুটবলের মূল স্রোত এখনও ঠিকপথে ধাববান নয়, সে দেশের ফুটবলে এমন খরচ অপচয়ই। আসলে মূলস্রোতের বাইরেই বইছে বাংলার ফুটবলের সবচেয়ে বেশি অর্থ।
এখানে বাংলার ফুটবলারদের বেশ রমরমা তবে তার সঙ্গে বিদেশি ফুটবলারদের যোগাযোগ রয়েছে অনেকটাই। বিদেশি আনিয়ে টুর্নামেন্টের প্রোফাইল বাড়ান অনেক আয়োজক। অনেক মাঠে টিকিট কেটে ফুটবল দেখতে আসেন দর্শকরা। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান এবং মহামেডান স্পোর্টিং-এর খেলা ছাড়া তেমন দর্শক সমাগম হয় না আজকাল। এমনকী আই লিগেও কিছু টিম ছাড়া, দর্শক সমাগম হয় না ইদানিং। অথচ, এই সমস্ত গ্রামীণ এবং পাড়া ফুটবলে পাঁচ থেকে দশ হাজার দর্শক সমাগম হয় এবং কুড়ি-তিরিশ বা তারও বেশি টাকার টিকিট কেটে মানুষ ফুটবল দেখেন এখানে।
এখন আপনারাই ঠিক করুন কোন দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলার ফুটবল? অতীতেও এমন ফুটবলের রমরমা ছিল কিন্তু তার সঙ্গেও ছিল মূলস্রোতের ফুটবলের হাতছানি। সবমিলিয়ে সেই মেলবন্ধন আজ টুটে গেছে। মূলধারার ফুটবল একদিকে আর অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের চোখে অচ্ছুত, সোশ্যাল ডিস্ট্যানস মেনে পড়ে থাকা পাড়া ফুটবল! যার সঙ্গে নিজের হৃদস্পন্দন অনুভব করছে বাঙালি অন্বয়। অথচ এই ফুটবলের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করে একজন একজন করে প্রতিভা বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার উদাহরণ অসংখ্য। এই ফুটবল জীবনের পর কী? কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে সে? সস্তা শ্রমিক হবে নাকি আমাদের কিশোর বেলার তারকারা, সকালের ট্রেন ধরে ময়দানে নন, যাবেন নাকি বানতলায় লেদার কমপ্লেক্সে?
অথচ খেলোয়াড়ি জীবন জুড়ে তাঁরা তারকাই। মূলধারার মিডিয়া তাঁদের বাইট বা ইন্টারভিউ নেবে না একথা ঠিক। কিন্তু তারকা তারকাই, স্কিল তো স্কিল-ই। যাঁর স্কিল দেখার জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে বসে থাকেন, যার ফাইটিং কোয়ালিটি, ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা দেখার জন্য মানুষের ছুটে আসা। ম্যাচ শেষে মানুষ যাকে মাথায় তুলে নাচে, তিনি তারকাই। যে স্তরের ফুটবলেই হোক, তিনি তারকা। অথচ সমস্যা এখানেই, আমাদের ফুটবলে মন্টু ঘোষ-এর মত মানুষদের বড় অভাব। ছোট মাঠের ফুটবল থেকে সঠিক তারকাকে খুঁজে আনতে পারতেন যাঁরা, তারা আজ নেই। এই সমস্ত মানুষেরা জুহুরীর চোখে ফুটবলার চিনতেন। একটু সুযোগ করে দিতেন কোনও ক্লাবে। তারপরটা নিজের শক্তি। সেই অদম্য প্রতিভাধর ফুটবলারই নিজেই লিখতেন ইতিহাস।ইদানিং নবাব ভট্টাচার্যের মত কতিপয় মানুষ ছাড়া, বাঙালি ফুটবলার উপস্থাপনার ক্ষেত্রটা বিগ জিরো। অভিবাবক-শূন্য অবস্থায় পড়ে আছেন বাংলার প্রতিভারা। ভবিষ্যত কী তাদের? কেউ জানেন না। খেপের মাঠে সারাজীবনের আক্ষেপ নিয়েই বুঝি শেষ হয়ে যাবে আস্ত একটা জীবন!