ভরসার আরেক নাম ব্যারেটো...

সুব্রত চন্দ্রঃ প্রতি বছরই শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে অনেক পরিযায়ী পাখি এই কলকাতা শহরে এসে ভিড় করে, আবার ফিরেও যায় শীতের শেষে। তবে এ তোতা পাখি ব্রাজিলের গ্রেমিও থেকে ৯৮ এর শীতের শুরুতে সেই যে এলো আজও যায়নি ফিরে। বরং বলাবাহুল্য ফিরে যেতে পারেনি।
মোহনবাগানি ঘরানায় জন্ম হলেও খুব ছোটবেলায় ইস্টবেঙ্গলের খেলা ভালো লাগতো, কিন্তু সমস্ত ধারণা পাল্টে দিয়েছিল এই মানুষটা। মোহনবাগানের প্রতি যদি প্রথম প্রেমে পড়ার কারণ কিছু হয়ে থাকে তা ওরই জন্য। বরং ওর জন্যই বিখ্যাত ছাতা কোম্পানি কে সি পালের স্লোগানে ভাটা পড়েছিল কিছুটা। মানুষ বলতে শুরু করল শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, ব্যারেটোই বর্ষা….আজ থেকে ১০০ বছর পরেও মনে হয় কলকাতা ময়দানে ব্যারেটো বললে এই স্লোগানটি থাকবে। কোটি কোটি মোহনবাগানের ভরসার জায়গা তো হল, কিন্তু তথাকথিত এক পরিযায়ী ব্রাজিলিয়ান কি করে নিজেকে আদ্যপান্ত বাঙালি করে তুলল সেটাই অবাক করার মত। এখানেই হয়তো মানুষ ব্যারেটো ফুটবলার ব্যারেটোর থেকে আরো এগিয়ে। দুবার জাতীয় লিগ দেওয়া ব্যারেটো যেমন ক্লাব রাজনীতির যাঁতাকলে পরে অনেকটা অভিমান নিয়ে ক্লাব ছেড়েছিল ঠিক তেমনই সেসময়ের সবথেকে বড় ক্লাব মহিন্দ্রা ইউনাইটেডের সমস্ত প্রলোভনকে উপেক্ষা করে ফিরে এসেছিল তার ভালোবাসার ক্লাবে। ততদিনে অবশ্য ময়দানে গড়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য "ব্যা-ভ্যা" জুটি।
পরের ছয় বছর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে, তখন মোহনবাগান আর তার প্রিয় সবুজ তোতা দুটোই সমার্থক। কোলকাতার ময়দানে আসা সর্বশ্রেষ্ঠ বিদেশি ফুটবলার কে? এটা নিয়ে তর্কটা হয়তো রয়েই যাবে..অনেকে মজিদ বাসকার কে এগিয়ে রাখবেন। তবে ওর মত এতটা ধারাবাহিক ভাবে দশ বারোটা বছর অন্য কোন ফুটবলার তার ক্লাবকে সাফল্য দিতে পেরেছি কিনা সেটা প্রশ্নাতীত।
সব ভালোর অন্তরায় যে পোয়েটিক জাস্টিস হতেই হবে এরকম কোন কথা নেই। তবুও বিদায়টা আরেকটু সুখকর হলেও হতে পারত। এতদিনে ওডাফা যুগ শুরু হয়ে গেছে মোহনবাগানে। এরমধ্যে কিছু সমর্থক তাদের ভরসার জায়গাটা ভুলে ওডাফা নামক এক গোল মেশিনের জার্সিতে নিজেকে রাঙিয়েছে। তাদের কাছে সবুজ তোতা আজ শুধুই এক ক্ষমতাচ্যুত সম্রাট। শুধু সমর্থকরাই কেন কিছু মোহনবাগান কর্তাও তো সেই প্রাপ্য সম্মানটুকু দিলেন না। হয়তো আবার অনেকটা অভিমান নিয়ে ক্লাব তাবু ছাড়লেন চোখের জলে, ওর একনিষ্ট সমর্থকদের ভালোবাসায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় জীবনের শেষ ম্যাচেও গোল করে নিজের দলকে জেতালেন এবং ম্যাচের সেরা হলেন।
এতটা পেশাদারিত্ব কি শুধুই ফুটবলের জন্য নাকি ক্লাবটাকে আপ্রাণ ভালোবাসার জন্য। উত্তরটা ওই ভালো দিতে পারবে…
শেষবার ওকে যখন দেখেছিলাম তখন আমি কলেজে পড়ি, একটা লেভেল ক্রসিংয়ে একটা খেলোয়ার ভর্তি বাস এসে দাঁড়ালো। প্রথমটা বিশ্বাস হয়নি তবে ভালো করে দেখে বুঝলাম একজন জানলার ধারে বসে আছে ব্যারেটো। বাসটা ছিল ভবানীপুরের টিম বাস। সেই ব্যারেটো যে কিনা আজ ভবানীপুরের। সমর্থকদের কোলাহল থেকে অনেক দূরে। নিজেকে স্পটলাইট এর আলো থেকে সম্পুর্ন গুটিয়ে নেওয়া এক অন্য ব্যারেটো দেখেছিলাম সেদিন। আমি হাত নাড়লাম। জানিনা ওর কাছে সেটা পৌঁছেছিল কিনা..বা বুঝতে পেরেছিলেন কিনা। যাই হোক সে ভবানীপুরের হোক কি মোহনবাগানের। তুমি ছিলে তুমি আছো তুমি থাকবে। আপামর বাঙালির হৃদয়ে…
শেষে বলি তুমি যতটা ব্রাজিলের ততটাই বাঙালির, যতটা পত্রো আলেগ্রের, ততটাই পশ্চিমবঙ্গের… ভালো থেকো সবুজ তোতা।