'বন্ধু'র কাছে চলে গেল আমাদের রনি দা...

সব্যসাচী বাগচী: সবসময় ওঁর মুখে একগাল হাসি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ওঁকে সর্বদা হাসতেই দেখেছি। গলায় ইয়াসির আরাফাতের মত বাহারি স্কার্ফ। পরনে জিন্স ও টি-শার্ট। অফিস ডিউটিতে থাকার সময় চপ্পল পড়া একদম পছন্দ করতেন না। নানান রঙের স্নিকার্স ছিল ওঁর কাছে। ব্যাগে বোঝাই করা ক্যামেরা, চার্জার, ব্যাটারি, লেন্স ও বেশ ভারি একটা ল্যাপটপ। ব্যাগটাও বেজায় ভারি ছিল। তবে একমাত্র ছবি তোলার সময়ই কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখতেন। সরকারি খাতায় ওঁর নাম রণজয় রায় হলেও, উনি আমাদের কাছে রনিদা। ভাগ্যের পরিহাসে ২০২০'র ২৪ এপ্রিল যিনি মাত্র ৫৭ বছর বয়সে অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন।
অজাতশত্রু মানুষটাকে সবাই ভালবাসতেন। ভুল লিখলাম। ভালবাসেন। আজীবন ভালবেসে যাবেন। উনিও সবাইকে কাছে টেনে নিতেন। ছোট, বড়, চিত্র সাংবাদিক, ক্রীড়া সাংবাদিক কোনও বাছবিচার ওনার মধ্যে ছিল না। এমনকি আমাদের সবার পরিবারের সদস্যদেরও চিনতেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। ময়দানের সব টেন্ট, কর্তার সঙ্গে ওর ছিল সখ্য। কথায় কথায় 'জয় গুরু' বলে ওঠা মানুষটাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, "রনি দা তোমার রাগ হয়না? কষ্ট হয়না?' হাসিমুখে জবাব দিয়েছিলেন, 'না। হয় না। কারণ, আমার রাগের কদর কেউ করেনি। আমার কষ্টের কদর কেউ কখনও করেনি। সবাই আমার পরিশ্রমের কদর করেছে। তাই আমিও কাজের মধ্যে থাকতে চাই। তোদের মত ছোট ছোট ভাইদের সঙ্গে থাকতে চাই।"
থাকলে আর কোথায় রনি দা? চলেই তো গেলে। গত ২৫ বছর ধরে 'আজকাল'এর ক্রীড়া বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলে। তারও আগে থেকে মিডিয়া জগতে তোমার দাপাদাপি। ময়দান যেমন তোমার প্রিয়, তেমনই খুব প্রিয় ছিল স্টুডিও পাড়া। কয়েকমাস আগের কথা। মজিদ বাসকর সেই রাতে কলকাতায় পা রাখবেন। তুমি আমহার্ট স্ট্রিটের বাড়িতে আসতে বললে। সেখানেই রাতের খাবার সেরে আমরা ছুটলাম বিমানবন্দরের দিকে। সন্ধের দিকে আমরা তখন আড্ডা মারছি। যে খাটে তুমি বসেছিলে, সেই খাট দেখিয়ে তুমি বলে উঠলে, "আমার বাবা স্বর্গীয় বিজয় রায়। নাম নিশ্চয়ই শুনেছিস। ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য টলিউডের সব বড় তারকারা আসত। বাবাও নেই। তাই আর কেউ এই বাড়ির দিকে ফিরেও তাকায় না।"
হ্যাঁ তুমি নেই। এটা সত্য। কিন্তু তুমি তো সব জায়গায় আছ। তুমি মোহনবাগান মাঠে আছ। তুমি ইস্টবেঙ্গলের প্র্যাকটিসে আছ। মনোজ-ঋদ্ধি নেটে ব্যাট করছে। তুমি একেবারে রেডি রনি দা। মহারাজদা ঠিক বিকেল ৫'টায় ইডেনে আসবেন। তুমি ক্লাব হাউসের সামনে ওঁকে ক্যামেরাবন্দি করার জন্য প্রস্তুত। টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, কাবাডি সব খেলার ফটোগ্রাফিতে তুমি সবার আগে উপস্থিত। যা আমাদের সবার কাছে শিক্ষণীয়।
তোমার মুখ থেকে কখনও 'না' শব্দটা শুনিনি। বারাসতেও ছুটছো। আবার কল্যাণী কিংবা শিলিগুড়িতেও তুমি। ভিনরাজ্যের আ্যসাইনমেন্টের কথা তো বাদই দিলাম। সেখানেও সফররত সাংবাদিকদের 'লোকাল গার্জেন' তুমিই। এই তো ২০১৯'এর ইংল্যান্ডে আয়োজিত ক্রিকেট বিশ্বকাপ। তোমার অফিস থেকে কোনও সাহায্য না পেলেও, স্রেফ প্যাশনের জেরে সব টাকা ইনভেস্ট করে ব্রিটেনে চলে গেলে। সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়েছ। ল্যাপটপ ও ফোন বিগড়েছে। তবুও রোজ 'আজকাল'এর খেলার পাতায় তোমার 'বাই লাইন' ছবি দেখেছি। তৃপ্তি পেয়েছি। ইংল্যান্ডে থাকলেও তুমি আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে। ভিডিও কলের মাধ্যমে।
ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর একদিন 'এই সময়'এর ফটোগ্রাফার অভিজিতের সঙ্গে দেখা। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, "রনিদা একটা কান্ড ঘটিয়েছে।" আমি বললাম, "কী করল আবার?" একগাল হেসে পল্টু বললো, "ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জেতার পর জেশন রয়ের কাছে গিয়ে হঠাৎ বলল, 'ইউ জেশন রয়। আই অ্যাম রনি রয়।" ওর কথা শুনে আমরা তো হেসে লুটোপুটি। তবে রনিদা নিজের খেয়ালেই ছিলেন।
আর ক্রীড়া সাংবাদিক কিংবা ফটোগ্রাফারদের হেল্প করা। সেগুলো নিয়ে লিখতে বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে। একদিন মোহনবাগান প্র্যাকটিস চলছে। এক তরুণ ক্রীড়া সাংবাদিক একটু দেরি করে মাঠে এসেছেন। ওকে সজোরে এক লাথি মেরে কাছে ডেকে নিল। বলল, "এই ছবিটা তোর ফটোগ্রাফার মিস করেছে। তোকেও তো সকালে দেখতে পেলাম না। এটাই কিন্তু কপি। একটু চেক করে নিস।" ইডেনেই বসে অফিসে ছবি পাঠাতেন। 'আজকাল'-এ ছবি ফাইল করার পর, রনিদা বসে যেতেন 'অনুরোধের আসর' নিয়ে। যাদের খিস্তি করতেন। যাদের কিল, চড়, ঘুষি মারতেন তাদের সাহায্য করার জন্য। বলতাম, "যারা মাঠে আসে না তাদের ছবি কেন দাও?" ওর জবাব ছিল, "যারা রোজ মাঠে আসে তারা কোনওদিন না আসতে পারলে তাদের সাহায্য করা আমার কর্তব্য। আমার আঙুল নিজে থেকে চলে যায়।"
খেলোয়াড়রা তোমাকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করতেন। তাদের কোনও ছবি দরকার হলেই তোমার ফোন বেজে উঠত। তুমিও তাদের ই-মেইল নিয়ে ছবি পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু আজকের পর থেকে এগুলো সবই অতীত। যে লোকটা আজীবন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে কাটিয়ে দিল, তাঁকেই একা চলে যেতে হচ্ছে! জগতের নিয়মে সবাইকেই একা চলে যেতে হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা হওয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোমাকে একা চলে যেতে হবে! ইচ্ছে থাকলেও তোমাকে শেষবারের মত দেখতে পারব না! এটা হজম করা খুব মুশকিল।
২০১৬ সালে পিঙ্কি দি চলে গেলেন। তারপর থেকেই তোমার মোবাইলের রিং টোন ছিল অনুপমের সেই বিখ্যাত গান……
'যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে
কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে
আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছ
যেটুকু রোদ ছিল লুকোনো মেঘ
দিয়ে বুনি তোমার সালে ভালোবাসা
আমার আঙুল হাতে কাঁধে তুমি লেগে আছ।'
ভবিষ্যতে এই রিংটোন বাজলেও তুমি আর ফোন ধরবে না। কারণ, তুমি যে এতক্ষণে তোমার বন্ধুর কাছে চলে গিয়েছো। ভাল থেকো রনিদা। এভাবেই হাসিমুখে থেকো। কিন্তু তবুও বলছি তোমার এই নিঃশব্দে বিদায় মেনে নিতে পারলাম না।