মা, বাবার কষ্টের দিনগুলি মাথায় রেখেই জাতীয় দলে পাকাপাকি জায়গা করতে চান প্রবীর দাস...

গোপাল রায়: প্রবীর দাস। কোটি টাকার ইন্ডিয়ান সুপার লিগে সবচেয়ে আলোচিত বাঙালি ফুটবলার। কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার রাস্তাটা মোটেই সহজ ছিল না প্রবীর দাসের। বরং অনেক বেশি ভর্তি ছিল খানাখন্দরে।
প্রবীরের তখন বয়স নয় কি দশ হবে, বঙ্কিম গাঙ্গুলি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। মা সন্ধ্যা দাস ভোর সাড়ে চারটের সময় উঠতেন। দু' বাড়ি রান্না ও তিন বাড়ির পরিচারিকার কাজ করে ঠিক সাড়ে ন'টার সময় আবার নিজের বাড়ি ফিরে আসতেন। প্রবীরকে সাড়ে দশটায় স্কুলে নিয়ে যাবেন বলে। তিনি প্রবীরকে স্কুলের মেইন গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে ওখান থেকেই আবার লোকের বাড়ি কাজ করতে চলে যেতেন। আর প্রবীর, স্কুলের মেইন গেট দিয়ে ঢুকে পিছনের গেট দিয়ে পালিয়ে যেত। বাতাবি লেবু পেরে ফুটবল খেলবে বলে। আবার ছুটির সময় কোনও না কোনও ছাত্রের অভিভাবকের সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসত। এই ভাবে চলতে চলতে পরীক্ষার সময় চলে এল। গার্জেন কল করা হল প্রবীরকে। স্কুলের ম্যাডাম প্রবীরের মাকে জানিয়ে দিলেন, তাঁর ছেলেকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না। তার কারণ সব ছুটি-ছাটা মিলিয়ে প্রবীর মাত্র ১৭ দিন স্কুলে উপস্থিত ছিল। শেষে পাড়ার কোচ অলোক রুদ্র ম্যাডামকে অনেক অনুরোধ করে প্রবীরকে পরীক্ষায় বসার ব্যবস্থা করে দেন। ছোটবেলা থেকেই এমনই ফুটবলের প্রতি নেশা ছিল প্রবীরের।
আসতে আসতে বড় হতে লাগল প্রবীর। ফুটবলের পাঠ নিতে থাকল অলোক রুদ্রের কাছে। একই সঙ্গে তাঁর চলতে থাকল খেলাধুলা ও পড়াশুনা। মা সন্ধ্যা দাস ও বাবা মনা দাসও তাঁর দুই ছেলেকে মানুষ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে থাকলেন।
মা সন্ধ্যা দাস পরিচারিকার কাজ করে সংসারে কন্ট্রিবিউট করলেও, বাবা মনা দাসই ছিলেন রোজগারের মূল উৎস। তিনি রোজ রিক্সা চালিয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা ঘরে আনতেন। আর সেই দিয়েই প্রবীর আর প্রবীরের দাদার পড়াশুনা-খেলাধুলা ও সংসারের প্রয়োজনীয় মোটামুটি মিটে যেত। কিন্তু একদিন রিকশা থেকে নামতে গিয়ে মনা দাসের পা স্পোকের মধ্যে ঢুকে গেল। বাড়িতে এসে তিনি কাউকে কিছু বললেন না। সেই নিয়েই রিকশা চালাতে গিয়ে মনা দাসের পা ক্রমশ নীল হয়ে যেতে লাগল। এক প্রকার বাধ্য হয়ে, জোর করে তাঁকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। চিকিৎসকরা তাঁকে ১২০০ টাকার ইনজেকশন দিয়ে, হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে বললেন। ছ' মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মনা দাস।
ওই সময় আর্থিক কষ্ট শুরু হল প্রবীর দের। রোজগারের আসল লোক বসে গেলে যা হয়। সংসারের যাবতীয় দায়িত্বটা চলে এল প্রবীরের মা সন্ধ্যা দাসের কাঁধে। কিন্তু মায়ের এই কষ্ট দেখতে পারলেন না প্রবীরের দাদা। ভাইকে ডেকে বললেন, তুই খেল। আমি কাজে লেগে পড়ছি। ফলে প্রবীরকে খেলোয়াড় তৈরি করতে মায়ের সঙ্গে দাদাও কাজে নেমে পড়লেন।
২০০৬ সালে পাঁচটা একাডেমিতে ট্রায়ালে গেলেন প্রবীর দাস। একটাতেও সুযোগ পেলেন না। বাড়ি ফিরে এলেন। দাদা ডেকে বললেন, সুযোগ পাসনি কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু খেললে সিরিয়াস খেল। ২০০৭ সালে আবার সেইল একাডেমির ট্রায়ালে গেলেন প্রবীর। পাঁচ'শ ফুটবলারদের মধ্যে জায়গা করে নিলেন তিনি।
ওই বছরই প্রবীরের দল সুব্রত কাপে সেমিফাইনালে হেরে গেলেও, সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে ১০ হাজার টাকা পেলেন তিনি। তারপরেই তাঁর কাছে এল মোহনবাগানের প্রস্তাব। কারণ ওই সময় আইএফএ একটা নিয়ম চালু করেছিল। কলকাতা লিগে বড় দলে অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবলার বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেইল প্রবীরকে ছাড়ল না। এরপর তাঁর ডাক আসে অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে। ওই সময় জাতীয় দলের দায়িত্বে ছিলেন কলিন টোল, সঞ্জয় সেন, গৌতম ঘোষরা। কিন্তু ফাইনাল ট্রায়ালের সাত দিন আগে হঠাৎই বাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটে যায় প্রবীরের। গ্যাস সিলিন্ডার লিক হওয়ায়, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন মা। সব কোচেদের অনুমতি নিয়ে গোয়া থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন তিনি। এই সময় তাঁকে দারুন সহযোগিতা করেন কোচেরা। ৫০০ টাকা করে দিয়ে তাঁর বিমানের টিকিট কেটে দিয়েছিলেন তাঁরা। পরে অবশ্য আবার তাঁকে জাতীয় দলে সুযোগ দিয়েছিলেন কলিন টোলরা।
অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে খেলতে গিয়েও, সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন প্রবীর। এএফসি কাপে তুর্কমেনিস্তান বিরুদ্ধে খেলতে নামার আগের দিন পেটের যন্ত্রনায় ছটফট করছেন প্রবীর। তড়িঘড়ি তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। চিকিৎসকরা তাঁকে দেখে বললেন, এখনই অস্ত্রোপচার করতে হবে তাঁকে। পেটে স্টোন হয়েছে। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট বিদেশে প্রবীরের অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নিল না। তাঁকে ইনজেকশন দিয়ে কোনোরকম খেলিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিল। ইনজেকশন নিয়ে খেলে তুর্কমেনিস্তানের বিরুদ্ধে একটি গোলও করেছিলেন প্রবীর। পরবর্তী কালে পৈলান অ্যারোজে তাঁকে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কলিন টোল। যাতে ওর কিংবা পরিবারের সমস্যা হলে, প্রবীর যাতায়াত করতে পারেন।
অ্যারোজে খেলার সময়ও আবার বাঁধা আসে প্রবীরের জীবনে। ইউনাইটেড বিরুদ্ধে খেলার সময় টোম্বা সিং তাঁকে অবৈধ ভাবে বাঁধা দেয়। এসিএলে চোট পেয়ে ছ'মাস মাঠের বাইরে চলে যান তিনি। আবার চোট কাটিয়ে ফিরে এসে পাপাসের কোচিংয়ে ডেম্পোতে যোগ দেন প্রবীর। ওখান থেকে লোনে এফসি গোয়া। কিন্তু সেখানেও চুটিয়ে খেলা হল না তাঁর। কোচ জিকোর নির্দেশ ঠিক মতো পালন করতে না পারায়। চেন্নাইয়ন ম্যাচের আগে তাঁকে পইপই করে জিকো বলে দিয়েছিলেন, তোমাকে টপকে কেউ যদি গোল করে যায়, যাক। বক্সের সামনে তুমি কিন্তু কাউকে ফাউল করবে না। ওদের কিন্তু এলানো আছে। ও দুর্দান্ত ফ্রি কিক করে। ঠিক তাই হল, চেন্নাইয়নের কাছে জোড়া গোলে হেরে গেল এফসি গোয়া। তারপর থেকে জিকোর কোচিংয়ে গ্যালারিতে বসেই কাটাতে হল তাঁকে।
দিল্লি ডায়নামোসেও তাই। রবার্তো কার্লোসের কোচিংয়েও একটা ম্যাচেও সুযোগ পেলেন না প্রবীর। সাইড লাইনে বসেই কাটাতে হল তাঁকে। পরপর দুই মরশুম না খেলার সুযোগ পেলে, যা হয়। তাই হল। অন্ধকার নেমে এল প্রবীরের জীবনে। ওই সময় সঞ্জয় সেন মোহনবাগানে খেলার প্রস্তাব দিলেন তাঁকে। যোগ দিলেন প্রবীর। দারুণ খেললেন কলকাতা লিগে। কিন্তু পরের মরশুম আইএসএল খেলার ইচ্ছা হল তাঁর। এটিকে তখন বেশ কিছু বাঙালি ফুটবলারদের প্রস্তাব দিচ্ছে। বাঙালি ফুটবলারদের ব্যাপারটা তখন দেখাশোনা করছেন অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়। তিনি সবাইকে ফোন করছেন। কিন্তু তাঁর কাছে আর অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়ের ফোন আসছে না। বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করার পর তাঁর কাছে একদিন অনিলাভ'র ফোন গেল। তিনি এটিকেতে যোগ দিলেন। তার পরের অধ্যায় তো সবারই জানা।
এখন প্রবীর দাস পরিচিত নাম। ফুটবল খেলে বাড়ি, গাড়ি, বিদ্যুৎ ভবনে চাকরি - সবই করেছেন। এখন তাঁর শুধুই লক্ষ্য আইএসএল খেলার পাশাপাশি ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়ে চুটিয়ে খেলার। তবে অন্ধকার জীবন ভুলে গিয়ে নয়। ওই জীবনকে পাথেয় করেই সামনের দিকে আরও এগিয়ে যেতে চান প্রবীর দাস।