২১ জুলাই পেল নতুন পরিচয়, এক ফুটবলপ্রেমীর চোখে রণক্ষেত্রের আকার নেওয়া ইস্টবেঙ্গল ক্লাব

সব্যসাচী ঘোষ : পেশাদারিত্বের হিসেবে গিয়েছিল কভার করতে, কিন্তু মানসিক দিক থেকে এক ফুটবলপ্রেমী হিসেবে গিয়েছিল লেসলি ক্লডিয়াস সরণীতে। যে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ভারতবর্ষকে বারবার গৌরবান্বিত করেছে, আজ তার অস্তিত্বসংকটের দিনে সমর্থকরা কেমন আওয়াজ তুলবে, সে নিয়ে যেন বড়ই উৎসুক ছিলাম।
গতকাল অর্থাৎ বুধবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সামনে বিক্ষোভে মেতে ওঠে একাধিক ফ্যান ফোরাম ও সমর্থকরা, যাদের দাবি ছিল, শ্রী সিমেন্টের দেওয়া ফাইনাল এগ্রিমেন্ট দেখাতে হবে, সেই এগ্রিমেন্ট সই করতে হবে, এবং আইএসএল খেলতে হবে। আর আর এক দিকে ছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্য ও সমর্থকরা, যাদের দাবি একটিই, ক্লাব বিক্রি করা চলবে না। বিক্ষোভের আঁচ বুঝে মোতায়েন ছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী।
এক দিকে ছিল বিক্ষোভকারী ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা, অন্যদিকে ছিল কর্তাপন্থী সদস্য-সমর্থকরা। মাঝে ছিলাম আমরা, অর্থাৎ সাংবাদিকরা। কভার করতে আসার আগে শুনলাম, গুন্ডাদের হাতে মার খেয়েছে আমার দুই সতীর্থ সাংবাদিক। সে নিয়ে সতর্কবাণীও এসেছিল আমার কাছে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, শত মার খেয়েও তারা আবারও খবর করবে, কারণ এটিই আমাদের নেশা, এটিই আমাদের পেশা।
কিন্তু দুই পক্ষের সমর্থকদের ভিন্ন স্লোগানের মাঝেও যে মিলটি ছিল, তা হল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মঙ্গলকামনা। দুই পক্ষই চায় ক্লাবের ভালো হোক, কিন্তু ইনভেস্টর-কর্তাদ্বন্দ্বে আজ দুই ভাই যেন আলাদা, যেন চিরশত্রুতে পরিণত হয়েছে। একেবারে মাঝে দাঁড়িয়ে যখন দুই পক্ষের ভিডিও করছিলাম, মনে হয়েছিল, যেন আদালতের এজলাসে দুই বাদি-বিবাদির ঝামেলা শুনতে ব্যস্ত রয়েছি।
বিক্ষোভকারী সমর্থকরা ছিল সংখ্যায় বেশি, আর তাদের গলার জোরও ছিল অনেক। কিন্তু তৈরি ছিল কর্তাপন্থী ক্লাব সমর্থকরা। আলোচনার বার্তা দিয়েছিল সদস্যরা, কিন্তু তা নস্যাৎ করে দেয় বিক্ষোভকারীরা। একের পর এক কর্তাদের গাড়ি আসছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের দিকে, কিন্তু সেগুলির গায়ে বিরোধী পোস্টার লাগিয়ে দেয়, কেউ বা গাড়িগুলির উপর আক্রমণও চালায়। বুঝতে পারছিলাম, বিক্ষোভের আঁচটা ক্রমশই বাড়ছে। যে কোনও মুহুর্তে যা খুশি হতে পারে।
ফোনে চার্জ ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। অফিস থেকে বারবার বলছে সাবধানে থাকার জন্য। অভিজ্ঞতার খাতিরে তারাও বুঝতে পেরেছিল কি হতে চলেছে। আড় তাই হল, রণক্ষেত্রের আকার নেয় লেসলি ক্লডিয়াস সরণী। পুলিশের লাঠিচার্জ আছড়ে পড়ে বিক্ষোভকারী সমর্থকদের উপর। প্রাণ হাতে নিয়ে পালায় সমর্থকরা। সাংবাদিকতার জীবনে বেশ কিছু লাঠিচার্জ ও গ্রেফতারির লাইভ কভারেজ করেছি, কিন্তু ময়দানে এই প্রথম। আর সেই দৃশ্য যে ছিল একেবারে চোখে না দেখার মত।
কলকাতা পুলিশ লাঠি দিয়ে একেবারে গরুপেটা করে সমর্থকদের উপর। ঘোড়সওয়ার পুলিশও উপস্থিত হয়। দেখি বাইক থেকে মারতে মারতে এক সমর্থককে রাস্তায় ফেলে দেয়, কাতরাতে থাকে সে, কিছু বলতে চায়। কিন্তু তার মুখ চাপা দিয়ে পুলিশ ভ্যানে তোলে। তার দাবি একটাই, গরীব পরিবার থেকে আসায় একমাত্র সম্বল বাইকটাকে যেন সুরক্ষিত রাখা হয়। নির্মমতা কাকে বলে দেখিয়েছিল কলকাতা পুলিশ। কার উস্কানিতে এই আচরণ, তা জানি না, জানতেও চাই না। শুধু এটুকু জানি, এই নির্মম অত্যাচারের গ্লানি আগেও এক ২১ জুলাই তারিখে এসেছিল, তারপর যা হয়েছে সবই ইতিহাস।
এরপর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায় লেসলি ক্লডিয়াস সরণীরা। বিক্ষোভকারীরা লাঠিপেটা খেয়ে যখন কাতরাচ্ছে, অপরদিকে আর এক পক্ষ সমর্থকরা ক্লাবে বসে আড্ডা মারছে, কেউ কেউ খাবার খাচ্ছে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, এই বিক্ষোভ নিয়ে কর্মকর্তারা কি বলবেন? এলেন স্বয়ং দেবব্রত সরকার। এসে দিলেন সকলকে বাইট, যার মূল বক্তব্য হল, সমর্থকরাও স্বাগত এই ফাইনাল এগ্রিমেন্ট দেখে যাওয়ার জন্য।
সব শেষে, যখন এসপ্ল্যানেড মেট্রোর দিকে ক্লান্ত পা আর ফোনে ১০ শতাংশ চার্জ নিয়ে হাঁটছি, তখন কেবল ভাবছি, কি পরিস্থিতি ঘটল শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবে। দীর্ঘ সময় ধরে এক পদ্ধতিতে চলা এই ক্লাব গত কয়েক বছর ধরে কর্পোরেটদের গ্রাসে বন্দী হয়েছে, কার্যত বাধ্য হয়ে। কিন্তু এই টানাপোড়েনের মাঝে ক্লাবের সমর্থকরাই মার খেল, ক্লাবের সমর্থকরাই যেন হতাশ হল। কে দোষী, কে নির্দোষ, সে আলোচনা পরে হবে। কিন্তু পুলিশের নৃশংসতায় আজ সত্যিই কালিমালিপ্ত হল কলকাতা ময়দান।