ইনভেস্টরেই মুক্তি, কলকাতা ফুটবলের নতুন স্লোগান!

সুভাষ ভৌমিক : একটু দূরে গিয়ে দেখব? জার্মানিতে যাই, চলুন সঙ্গে। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান পরিকাঠামো, সবচেয়ে সফলও। বায়ার্ন মিউনিখ একা নয়, বোরুসিয়া ডর্টমুন্ডও আছে ফোর্বস-এর সবচেয়ে দামী ২০ ক্লাবের তালিকায়। তাদের পরিকাঠামোয় নজর দেবেন? জার্মানির ক্লাব ফুটবলে নিয়ম ৫০+১। বুঝে নিই ব্যাপারটা ঠিক কেমন।
বোরুসিয়ার সিইও বলেছিলেন, ‘জার্মান ফুটবলের ভক্তরা যদি বুঝতে পারে যে তাদের ভক্ত হিসাবে নয়, কাস্টমার হিসাবে দেখছে ক্লাবগুলো, সমস্যা হতে বাধ্য।’ তাই, জার্মান ফুটবলে ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্লাব অচল। কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা বা ইনভেস্টর ক্লাবের সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশের বেশি মালিকানা পাবে না, নিয়ম। ‘জার্মান ফুটবল লিগ’, বুন্দেশলিগা চালানোর দায়িত্বে যারা, পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, কোনও ক্লাবে যদি ইনভেস্টরের মালিকানা ৪৯ শতাংশের বেশি থাকে সেই ক্লাব খেলতে পারবে না বুন্দেশলিগায়।কেন এমন? প্রথমত, ক্লাব-সাপোর্টারদের ইচ্ছেকে দুরমুশ করে শুধু ‘প্রফিট’-এর লোভে ক্লাব চালানো যাবে না। দ্বিতীয়ত, বেপরোয়া এবং স্বৈরাচারী মালিকের ইচ্ছেকে প্রাধান্য না দিয়ে জার্মান ক্লাবগুলোর গণতান্ত্রিক পরিচালন পদ্ধতি ধরে-রাখা।
কোনও এক গ্লেজারের কারণে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-এর খেলা বন্ধ করে দেওয়ার মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপ সেই কারণে করতে হয় না জার্মান ক্লাবের সমর্থকদের। বা, কোনও এক রোমান আব্রামোভিচ এসেই ক্লাব-পরিচালন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের সর্বনাশ করে দিতে পারেন না টাকার জোরে। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজরা কথায় কথায় ‘ছেড়ে চলে যাব’ হুমকি দিতেই পারেন, জার্মান ক্লাব প্রাথমিক কথাবার্তায় আগ্রহী হয়েও শেষে সই করতে পারে না। এমনকি বার্সেলোনার নবনির্বাচিত সভাপতিও সই করার আগে বাধ্য হন নতুন ‘ক্লজ’ যুক্ত করতে যে, ‘সমর্থকরা না চাইলে আমরা কিন্তু বেরিয়ে যাব’।
জার্মান ক্লাবগুলোর ক্ষেত্রে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ব্যক্তি মালিকানা নিষিদ্ধ ছিল। ক্লাবগুলো চালানো হত অলাভজনক (নট ফর প্রফিট) সংস্থার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। ওই ১৯৯৮ সালে ৫০+১ নিয়ম জারি হয়। তারপর থেকেই জার্মান ক্লাবগুলোর দেনার পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে এবং এখনও কম তো বটেই, নেই বললেই চলে। জার্মানিতে আকাশছোঁয়া দাম দেওয়ার রীতি একেবারেই পরিত্যজ্য। আর ধার কম এবং আকাশছোঁয়া দামে তারকা কেনার প্রচলিত ইউরোপীয় পদ্ধতি নেই বলেই বুন্দেশলিগায় টিকিটের দাম বেশ কম। নিম্ন এবং মধ্যবিত্তের আয়ত্তের মধ্যে। ভক্তরা টিকিট কেটে মাঠে আসতে পারেন। একটা ম্যাচের টিকিট কাটলে পরেরটার জন্য আবারও দু-মাস অপেক্ষা করতে হয় না। ‘গেটসেল’ এতটাই ভাল যে, ছোট ক্লাবগুলোর খেলাতেও মাঠ ভর্তি থাকে সর্বদা। খরচে টান থাকায় গোটাটাই নিয়ন্ত্রণে।
সবচেয়ে বড় কথা, এই পদ্ধতিতে কোথাও সমর্থকদের দুচ্ছাই করে নিজের মতামত জোর করে ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত নেই! বোরুসিয়ার সিইও বলেছিলেন, ‘এই ৫০+১ নিয়মই আমাদের রক্ষাকবচ। এখানে কোনও রোমান আব্রামোভিচ শুধুই লাভের গুড় খেতে আসতে পারবে না। ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লাব চলে শুধুই আরও লাভের লক্ষ্যে। জার্মান ফুটবলে তার কোনও স্থান নেই।’
২০০৯ সালে ৫০+১ নিয়ম ভাঙার জন্য সরকারিভাবে আবেদন করেছিলেন হ্যানওভার প্রেসিডেন্ট। ৩৫ পেশাদার ক্লাবের মধ্যে ৩২টিই বিরুদ্ধে ভোট দেয়, বাকি তিনটি ক্লাব পক্ষে বা বিপক্ষে কোনও ভোটই দেয়নি! জার্মান লিগ পরিচালন সংস্থার প্রেসিডেন্ট জানিয়েছিলেন, ক্লাবগুলির এমন আচরণে তাঁর সন্তুষ্টির সীমা নেই। ব্যক্তি-সংস্থার লোভনীয় কোনও প্রস্তাবের কাছে মাথা বিকিয়ে দেয়নি ক্লাবগুলো, যরপরনাই খুশি হয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘ক্লাবগুলো বুঝিয়ে দিল আরও একবার, বুন্দেশলিগা যে প্রাথমিক নিয়মগুলো বেঁধে দিয়েছিল, সবাই তা মেনে চলতে তৈরি। সঙ্গে বুন্দেশলিগার তিনটি প্রাথমিক লক্ষ্যের – স্থায়িত্ব, ধারাবাহিকতা এবং ভক্তদের কাছাকাছি থাকা – সঙ্গে তাদের কোনও বিরোধ নেই।’
ব্যতিক্রম আছে। ৫০+১ নিয়ম ভেঙে কোনও ইনভেস্টর পারেন মালিকানার শেয়ার বাড়াতে। তার জন্য অবশ্য সেই সংস্থাকে অন্তত কুড়ি বছর একটানা সেই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে, প্রথম দলের পাশাপাশি অন্যান্য দলগুলো এবং অ্যাকাডেমির জন্য যথেষ্ট খরচ করতে হবে এবং অবশ্যই মেনে চলতে হবে বুন্দেশলিগার তৈরি বিধিনিষেধ।
পাঠক মনে রাখতে পারেন, ২০০৯ সালে আরবি লাইপজিগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ওই ২০০৯ সালে। অস্ট্রিয়ার বিশ্ববিখ্যাত এনার্জি-ড্রিঙ্ক নির্মাতা রেড বুল নিয়েছিল পঞ্চম ডিভিশনের মার্ক্রানস্টাডট-এর ভার। এরপর প্রতিটি বিভাগ থেকে উঠতে উঠতে লাইপজিগ এখন বুন্দেশলিগার অন্যতম সেরা দল যারা চ্যাম্পিয়নস লিগেও খেলে এবং অঘটন ঘটায়। রেড বুল ইনভেস্টর বলেই তাদের ‘আয় বাবা প্রথম ডিভিশনে খেল্’ বলে আসনপিঁড়ি পেতে দেয়নি কোনও সংস্থা। ক্লাব এবং ইনভেস্টরও চায়নি তেমন, কারণ, জানত চাইলে পাবে না!
বায়ার্ন মিউনিখের সরকারি সদস্য সংখ্যা ২ লক্ষ ৯০ হাজার। তাঁদের সকলের ভোটাধিকার আছে। কিন্তু ইনভেস্টরদের সকলের সেই অধিকার নেই, হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া।
ইউরোপের অন্যান্য লিগগুলোতে পেট্রোডলারের রমরমা, বিশেষত ইংল্যান্ডে। তাই ইংরেজ সাধারণ ভক্তরা ক্রমাগত বিষোদ্গার করেন মালিকদের বিরুদ্ধে, প্রধানত টিকিটের দাম নিয়ে যা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিল অনেক দিন আগেই। তা সত্ত্বেও, লাগাম না পড়িয়ে বাড়িয়েই দেওয়া হচ্ছে প্রতি বছর। কিন্তু, বিশেষত ইউরোপীয় স্তরে নিয়মিত সাফল্যের জন্য অর্থের প্রয়োজন অস্বীকার করাও যায় না। তাই বায়র্নের সিইও কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে একবার বলে ফেলেছিলেন, ক্লাবগুলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া হোক, বাইরের ইনভেস্টরদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হবে কিনা, ঠিক করে নিক তারাই।
অন্য সব ক্লাব একজোট হয়ে সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় রুমেনিগের প্রস্তাবও আস্তাকুঁড়ে গিয়েছে, এতটাই জোরালো বুন্দেশলিগার সংগঠকরা। ‘ইংরেজ ভক্তদের মতো জার্মান ফুটবল ভক্তদের শুষে নেওয়া চলবে না’, দাবিতে অনড় তারা।
তখনও উয়েফার সভাপতি ছিলেন মিশেল প্লাতিনি। জার্মানির এই ৫০+১ নিয়মের উচ্ছসিত প্রশংসা করে জানিয়েছিলেন, জার্মান ফুটবল ঠিক দিকে চালিত হচ্ছে এই নিয়মের বেড়াজালে থেকেই।
হঠাৎ করে যদি ভারতে চলে আসেন? দেখবেন, ইনভেস্টরের জন্য সব দরজা খুলে দিতে দিতে ক্লাব কর্তৃপক্ষ এখন বাড়ির বাইরে ফুটপাথে বসে আছে ভিক্ষেপাত্র হাতে!
আমরা পরিকাঠামোগত দিক দিয়েও যা ঠিক বা যা করা উচিত, কখনও করি না। লিফটে চড়ে উঠতে চাই আর ভেসে যেতে চাই গড্ডলিকা প্রবাহে। ফুটবল প্রশাসকদের মতোই ফুটবল ভক্তরাও এখানে একই রকম দৈন্যদশায় আক্রান্ত। ইনস্ট্যান্ট কফির স্বাদ নিতে আগ্রহী, কফি বানানোর প্রক্রিয়া না শিখে, না জেনে, পরিশ্রমটুকু না করে, পড়াশোনা না করে তো বটেই!কলকাতা ফুটবলের পরিপ্রেক্ষিতে কী করা যেতে পারে ভাবলে প্রথমেই মনে হয়, বড় ক্লাবের মাঠগুলোকে এজমালিমুক্ত করা হয়ত প্রথম ধাপ। জানি, সেনাবাহিনীর দখল আছে। এখানে বিরাট ভূমিকা নিতে পারেন পশ্চিমবঙ্গে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ব্রিটিশ আমলে যখন সেনাবাহিনীর দখলে রাখা হয়েছিল ময়দান, উদ্দেশ্য ছিল, নদীপথে আক্রমণ প্রতিহত করা। আজ নদীপথে আক্রমণের সম্ভাবনা আর নেই। অন্তত বড় ক্লাবগুলো নিজেদের মাঠের মালিকানা পেতে পারে না? সেই ব্রিটিশ আমলের নিয়ম মেনে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া আছে এরিয়ান্স-কে, মোহনবাগান মাঠের সঙ্গে সিএফসি জুড়ে আছে। ক্লাবের হাতে মাঠ না থাকলে গ্যালারির সংস্কার করা যাবে না। আর গ্যালারি সংস্কার না হলে উৎসাহিত করা যাবে না আরও সমর্থককে মাঠে আসার জন্য। মালিকানা পেলে তিন বড় ক্লাবই এব্যাপারে আরও উদ্যোগী হবে, নিশ্চিত। তখন সমর্থকরা নিজেদের মাঠে নিজেদের ক্লাবের খেলা দেখার ব্যাপারে আরও বেশি আকৃষ্ট হবেন যেমন, ক্লাবের সদস্যপদ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা নিতে পারে মাঠের মালিকানা। গ্যালারিতে জায়গা বাড়লেই সদস্যদের খেলা দেখতে দেওয়ার সুযোগও বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে ক্লাবের আয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খেলা ভালবাসেন। গত বছর দশেকে বারবারই দেখা গিয়েছে, প্রযোজনে ময়দানের ফুটবল ক্লাবগুলোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে ঠিকঠাক বোঝাতে পারলে তিনিই উদ্যোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। ক্লাবের হাতে মাঠের মালিকানা না থাকলে, মাঠ ঠিক করার জন্যও বাড়তি উদ্যোগী হওয়া অসম্ভব – কলকাতা ময়দানের সঙ্গে যুক্ত আমরা সবাই জানি।
আর ইনভেস্টর প্রসঙ্গেও জার্মান-মডেল অনুসরণ করা উচিত। যে সংস্তা আসবে টাকা ঢালতে, ক্লাবের মালিকানার প্রশ্ন নিয়ে ভাববে কেন? প্রচার যতটা পাওয়া যায় ইস্ট-মোহন নামের