পারিষদ-পক্ষ

সত্তরের দশক, উত্তাল দক্ষিণ আফ্রিকা। তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী ভর্স্টার ছিলেন হিটলারের ভক্ত। জাতীয় ক্রিকেট দলে কৃষ্ণাঙ্গরা কেন সুযোগ পাইবেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলিয়াছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মেধা নাকি এতোই স্বল্প যে তাহাদের পক্ষে ক্রিকেট বুঝা সম্ভবপর নহে।
উত্তরে একজন ক্রিকেটার তাঁহার চক্ষে চক্ষু স্থাপন করিয়া , ক্রুদ্ধ স্বরে বলিয়া উঠিয়াছিলেন - "গ্যারি সোবার্স এর নাম শুনিয়াছেন ?" ।
ক্রিকেটারটি অন্য কেহ নন, স্বয়ং স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান।
সাল ১৯৬৬। কেরিয়ারের মধ্যগগনে স্থিত এক কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলিট কারারুদ্ধ করিবার রাষ্ট্রীয় হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করিয়া সাফ জানাইয়া দিলেন, দেশের যুদ্ধবাজ নেতাদের আদেশ মাথায় লইয়া, দুর্বল - গরীব মানুষের দেশ ভিয়েতনাম আক্রমণ করিতে যুদ্ধে গমন তাঁহার পক্ষে সম্ভবপর নহে। শাস্তি হিসেবে নামিয়া আসিল রাষ্ট্রীয় নির্বাসন, আপনার শ্রেষ্ঠ জীবনকালের পাঁচ-পাঁচটা বৎসর হরণ করিয়া লওয়া হইল। তবু তিনি নিজ অবস্থান হইতে কেশমাত্র নড়িলেন না। মানুষটি অপর কেহ নন, বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ , বক্সিং সম্রাট মহম্মদ আলী।
খেলাধুলা প্রকৃতই লড়াই , কিন্তু সেই লড়াই অসাম্যকে প্রশ্রয় প্রদান করে না। বরং কর্ণ টানিয়া শিখাইয়া দেয়, হেথা সকলের জন্য প্রযোজ্য নিয়ম একই। রাজা-উজীর বলিয়া কোনও নিশ্চল গদি সেথা নাই। তাহার শীর্ষে পৌঁছনোর রাস্তাটিও তাই কঠিন, কেবল পরিশ্রম আছে, কোনওরূপ শর্টকাট লইবার পথ নাই। সেই জন্যই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদরা হইয়া ওঠেন জাতীয় নায়ক। প্রসঙ্গত, ভারতীয় ক্রীড়া জগতের অবিসংবাদী নায়কের নাম সচিন তেন্ডুলকর। লক্ষ মানুষের ভগবান, বাঁচিয়া থাকিবার প্রেরণা তিনি। ক্রীড়াবিদ্যায় এইরূপ সম্মানের দাবিদার হিসেবে তাঁহার তুলনায় যোগ্যতর কেহ নাই একথাও সত্য বটে।
তথাপি, তথাপি ইহার পরও একখানি প্রশ্ন আসিয়া উপস্থিত হয়; নায়কের একমাত্র কর্ম কী সিংহাসনে আরোহণ? নাকি তাঁহার দায়বদ্ধতা প্রকৃতপক্ষে ওই মানুষগুলির প্রতি যাঁহারা তাহাকে ওই সম্মানে বসাইয়াছেন?
বিতর্কের কেন্দ্র আর কিছুই নহে। দেশব্যাপী চলমান কৃষক-দ্রোহ। সেথা কী হইয়া চলিতেছে , তাহার সত্যতা সকলেরই জ্ঞাত। তথাপি সেলিব্রিটিগণ রহিয়াছিলেন মুখে কুলুপ আঁটিয়া। গোল বাঁধিলো তখন, যখন জনা কয়েক নামজাদা বিদেশিনী দুম করিয়া কহিয়া বসিলেন, "রাজা তোর কাপড় কোথায় ?"
বিদেশিনী হইবার সুবাদে, তাঁবেদার শিল্পপতিগণের অর্থে জাবর কাটিয়া চলা 'সংবাদমাধ্যমের' টিভি শোতে চিল-চিৎকার করিয়াও তাঁহাদের জবাই করা কিঞ্চিৎ অসম্ভব। অতএব মাঠে নামিলেন দেশীয় 'সেলিব্রিটি'গন। 'মিনিস্ট্রি অব এক্সটার্নাল এফেয়ার্স' - এর জারি কৃত বয়ানে ব্যাখ্যা করা হইল কীরূপে দরদী সরকার যত্ন করিয়া সর্ব সমস্যার সমাধান করিতে তৎপর। ইহার পরই শুরু হইল ভজন। রবি ঠাকুর সেই একশো বৎসর পূর্বেই লিখিয়াছিলেন, "বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ "। ভদ্রলোক কতখানি দূরদর্শী তাহা বোধহয় এইদিন পুনরায় অস্থিতে অস্থিতে বোধগম্য হইল। গড্ডলিকা প্রবাহে যোগদান করিলেন তাবড় তাবড় ক্রিকেটার, এমনকি স্বপ্নের নায়ক সচিনও। সরকার দ্বারা নির্দিষ্টকৃত 'হ্যাশট্যাগ' জুড়িয়া, বিধিবদ্ধ শব্দবন্ধ বসাইয়া বসাইয়া জানাইয়া দিলেন, দেশের 'অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে' মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই কাহারো, যাহা বুঝিবার তাহা বুঝিয়া লহিতে ভারতীয়রাই যথেষ্ট, বাহিরের কাহারও প্রয়োজন নাই কথা কহিবার। বুঝিতে সমস্যা হয় না, উহা আসলে "এক দেশ এক টুইট"-এরই নামান্তর মাত্র। অদ্য সমস্যা হইল আমরা 'ভারতীয়' বলিতে কী বুঝি? সরকারী 'হ্যাশট্যাগ' ? পুতুলনাচ? কাঁটাতারে ঘিরিয়া রাখা জমি খন্ড? নাকি দেশ হইল ওই এক খণ্ড জমিতে বসবাস করিয়া চলা মানুষদিগ?
সোশ্যাল মিডিয়ার গুন্ডামী - তাঁবেদার সাংবাদিকদের ভজনের বাহিরে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গৃহের আরাম কেদারার বাহিরে, ফেরারি - বিএমডব্লিউ গাড়ির কালো দর্পণের বাহিরে যে একখানি ভারতবর্ষ উপস্থিত, তাহার অধিবাসী যাহারা তাঁহারা ভারতীয় নহেন? নাকি পাঞ্জাবের লঙ্গরখানা চালক, বাংলার চাষা, বিহারের শ্রমিক, কেরালার জেলে, মহারাষ্ট্রের ডাব্বাওয়ালা, আসামের চা শ্রমিক সকলেই ভারতীয়? শাসকের পক্ষে হউক বা বিপক্ষে, আপনার হক বুঝিয়া লইবার অধিকারে বিংশ তল অট্টালিকার কৃত্রিম উষ্ণ স্নানাগারে স্নানরত ধনকুবের এবং শহরের ফুটপাথে শৈত্যপ্রবাহে চাদর গাত্রে জড়াইয়া শয্যাশায়ী ভিখিরিও সমান ভারতীয় একথা কী কেহ অস্বীকার করিতে পারেন?
শাসকের সুনজরে থাকিবার সুবিধা বহু, মেরুদণ্ডের পরিশ্রম হয় অতিস্বল্প। তাহার নিমিত্তই হয়তো সচিনেরা পক্ষ লইয়াছেন। লইতেই পারেন, সেটি তাহার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। কিন্তু ইতিহাসের পৃষ্ঠার কোন পক্ষে তাঁহার ঠাঁই হয়, স্যার ব্র্যাডম্যানদের পক্ষে , নাকি 'চোপ সরকার চলিতেছে'-র পক্ষে সেকথা সময়ই বলিবে।
-আকাশ দেবনাথ, এক্সট্রা টাইম বাংলা।