গাহে তব জয়গাথা, ২৮ বছরের গ্লানির মুক্তির আজ এক দশক অতিক্রান্ত

সব্যসাচী ঘোষ : আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে, ২০১১ সালের ২ এপ্রিল, সেই দিন প্রতিটা স্কুলেই অর্ধদিবস ছুটি, প্রতিটা অফিস যেন ক্লাবের ঠেক, প্রতিটা রাস্তা যেন স্টেডিয়ামের গ্যালারি হয়ে উঠেছিল। ২০০৩ সালের পর আবারও বিশ্বকাপের ফাইনালে টিম ইন্ডিয়া। ১৯৮৩ সালের পর ২০০৩ সালে সুযোগ পেয়েছিল সৌরভ গাঙ্গুলির টিম ইন্ডিয়া, কিন্তু পরাক্রমী অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাস্ত হয় তারা।
আর সেই দীর্ঘ গ্লানি, দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটেছিল ২০১১ সালে। সেই ভারতীয় দলে ছিল জাহির-হরভজন-শচিন-সেহওয়াগের অভিজ্ঞতা, আর ছিল বিরাট-রায়না-গম্ভীর-শ্রীশন্থের তারুণ্য। আর তার উপরে ছিল এক তরুণ অধিনায়ক, যার চোখে ছিল একরাশ স্বপ্ন, কিন্তু বাইরে সে ক্যাপ্টেন কুল। নাম তার মহেন্দ্র সিং ধোনি।
মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম ম্যাচের আগে উৎসবে মেতেছিল মূলত দুটি কারণের জন্য। এক, ঘরের ছেলে শচিনের স্বপ্নপূরণ ঘটতে চলেছে এই মাঠেই, আর দেশের বিশ্বসেরা। কিন্তু সামনে ছিল দুর্ধর্ষ শ্রীলঙ্কা, মালিঙ্গা-সাঙ্গাকারা-জয়বর্ধনে-মুরলীধরণ সমৃদ্ধ এক অসাধারণ দল, যারা যোগ্য হিসেবে উঠেছিল ফাইনালে।
শুরুতেই জাহিরের অসাধারণ স্পেল। উপুল থরঙ্গাকে শুরুতে আউট করে চাপ তৈরি করে দিয়েছিলেন জাহির। বাঁ হাতি সেই পেসার নিজের সুইং ও বৈচিত্র্যের মাধ্যমে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছিলেন শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানদের। যোগ্য সহায়তা দিয়েছিলেন হরভজন সিং এবং যুবরাজ সিং। দুই পাঞ্জাব তনয় যেন মুম্বইকে মোহালি বানিয়ে দিয়েছিলেন নিজেদের দাপটে।
কিন্তু ভারতের দাপটের মাঝে একা কুম্ভ হয়ে লড়ে গেলেন মাহেলা জয়বর্ধনে। শ্রীলঙ্কার এই স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান নিজের ক্লাস ও স্কিলের মাধ্যমে দেখিয়ে দিলেন, বিশ্বকাপের অন্তিম মঞ্চে তিনি এসেছেন রাজ করতে। দুর্দান্ত শতরান করে শ্রীলঙ্কাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জয়বর্ধনে।
সামনে ২৭৪ রানের লক্ষ্য, আজকের দিনে সেটি কম হলেও সেইসময় ছিল বেশ কঠিন লক্ষ্য। আর ফাইনালের মঞ্চে সেই লক্ষ্য যেন ৩৭৪ এ গিয়ে ঠেকে যায়। আর সেই চাপের উপর আড়ত হিসেবে জোড়েন লাসিথ মালিঙ্গা। ইয়র্কারের রাজা দুটি অসাধারণ ডেলিভারিতে আউট করেন ভারতের দুই দুরন্ত ওপেনার বীরেন্দ্র সেহওয়াগ ও শচিন তেন্ডুলকরকে। না! শততম শতরানটা ঘরের মাঠে ফাইনালে আর দেখা হল না মুম্বই তথা ভারতবাসীর।
তবে কি আবারও ২০০৩ এর প্রতিফলন? না! কারণ ২০১১ এর ভারত আরও বেশি প্রত্যয়ী। লড়াইয়ে নেমেছিলেন দিল্লির দুই তরুণ গৌতম গম্ভীর ও বিরাট কোহলি। সাবধানী অথচ গুরুত্বপূর্ণ পার্টনারশিপ গড়ে তোলেন এই দুই ব্যাটসম্যান। ধীরে ধীরে ভারতের জাহাজকে আবারও স্থিতিশীল করতে লেগে পড়লেন তারা।
বিরাটের আউটের পর টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার যুবরাজ নামবেন, এমনটাই আশা করেছিলেন সকলে। কিন্তু নামলেন বিশ্বকাপে চুড়ান্ত অফ ফর্মে থাকা মহেন্দ্র সিং ধোনি, অধিনায়ক হিসেবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এত বড় ঝুঁকি কেন নিলেন ধোনি? প্রশ উঠেছিল। কিন্তু ধোনি যে ২০০৭ সাল থেকেই ঝুঁকি নিতেই পছন্দ করেন। মনে নেই ২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ ওভার?
আর তারপর যেন মহারণ শুরু করল ধোনি-গম্ভীর। আজকের দিনের দুই সাপে-নেউলে যেন সেদিন দুই ভাইয়ের মত দেশকে বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছিল। গম্ভীর ৯৭ রানে আউট হলেও দমেননি ধোনি। সতীর্থ তথা প্রিয় বন্ধু যুবরাজকে নিয়ে শ্রীলঙ্কার কফিনের শেষ পেরেকটি পুঁতছিলেন এমএসডি। শ্রীলঙ্কার হাত থেকে ম্যাচ বার করে নেন ধোনি।
আর তারপরেই ঘটল ইতিহাস। ১১ বলে চার রান বাকি, এই অবস্থায় পেসার নুয়ান কুলাসেকরার বলে লং অনের উপর দিয়ে বিশাল ছয় মারলেন ধোনি, আর ধারাভাষ্যে রবি শাস্ত্রীর সেই অমর কথা, “Dhoni Finishes it off in style, a magnificent six into the crowd, India lift the world cup after28 years, and the party started in the dressing room, as an Indian captain, who played absolutely magnificent, in the night of the final.”
১০ বছর পেরিয়ে গেল, আজও যেন এই ফাইনাল দেখলে লোম খাঁড়া হয়ে ওঠে প্রতিটি দেশবাসীর। ধোনির ছয় কখনই ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিলিপি নয়, ধোনির এই ছয় যেন দুর্গাপুজোর অষ্টমীর অঞ্জলির মত – রীতির সব থেকে উল্লেখযোগ্য এবং মনে পড়ার মত অংশ।